শুঁয়োপোকার রোয়াবটা দেখলেন? মন্তব্য করলেন লালমোহন গাঙ্গুলী।
ফেলুদা বলল, ব্যাড লাক্। ট্রেনটা লেট ছিল। অথচ সেটার সুযোগ নিতে পারলাম না। পোকরানে হয়তো একটা ট্যাক্সিও পাওয়া যেতে পারত।
গুরুবচন সিং বুদ্ধি করে আমাদের মালগুলো সব হাতে করে নিয়ে আসছিল, কিন্তু এখন আর তার প্রয়োজন হবে না। লাইনের দিকে চেয়ে দেখলাম, এখন আর ধোঁয়া ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
বাট হায়ার্ট অ্যাবাউট ক্যামেলস? উত্তেজিত স্বরে হঠাৎ বলে উঠলেন জটায়ু।
ক্যামেলস? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
ওই তো!
সত্যিই দেখি, আরেকটা উটের দল আসছে যোধপুরের দিক থেকে।
গুড আইডিয়া। চলুন!
ফেলুদার কথায় আবার দৌড়।
সে রকম খেপে উঠলে নাকি উট টায়েন্টি মাইলস্ পার আওয়ার ছুটতে পারে—ছুটতে ছুটতেই বললেন লালমোহনবাবু।
উটের দলকে থামানো হল। এবারে দুজন লোক আর সাতখানা উট। ফেলুদা প্রস্তাব করল—রামদেওরা যাব, তিনটে উট কত লাগবে বলো। এদের ভাষা আবার হিন্দি নয়; স্থানীয় কোনও একটা ভাষায় কথা বলে। তবে হিন্দি বোঝে, আর ভাঙা ভাঙা বলতেও পারে। গুরুবচন সিং এসে আমাদের হয়ে কিছুটা কথাবার্তা বলে দিল। দশ টাকায় রাজি হয়ে গেল উট ভাড়া দিতে।
দৌড়ানে সেকেগা আপকা উট? লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করলেন। ট্রেন ধরনে হোগা।
লুব্ধ হেসে বলল, আগে তা উঠুন। দৌড়ের কথা পরে।
উঠব?
এই প্রথম বোধহয় লালমোহনবাবু উটের সামনে পড়ে তার পিঠে ওঠার ব্যাপারটা তলিয়ে দেখলেন। আমি জানোয়ারগুলোকে ভাল করে দেখছিলাম। কী বিদঘুটে চেহারা, কিন্তু কী–বাহারের সাজ পরিয়েছে তাদের। হাতির পিঠে যেমন ঝালরাওয়ালা জাজিম দেখেছি। ছবিতে, এদের পিঠেও তাই! একটা কাঠের বসবার ব্যবস্থা রয়েছে, তার নীচে জাজিম। জাজিমে আবার লাল-নীল-হলদে সবুজ জ্যামিতিক নকশা। উটের গলাও দেখলাম। লাল চাদর দিয়ে ঢাকা, আর তাতে আবার কড়ি দিয়ে কাজ করা। বুঝলাম, যতই কুশ্রী হোক, জানোয়ারগুলোকে এরা ভালবাসে।
তিনটে উটি আমাদের জন্য মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসেছে। আমাদের দুটো সুটকেস, দুটো হোণ্ড-আল আর ছোটখাটো যা জিনিস ছিল, সবই গুরুবচন সিং এনে জড়ো করেছে। সে বলে দিল, ট্রেন ধরতে পারলে আমরা যেন পোকরানে অপেক্ষা করি; আজ রাত্রের মধ্যে সে অবশ্যই পৌঁছে যাবে। মালগুলো অন্য দুটো উটের পিঠে চাপিয়ে বেঁধে দেওয়া হল।
ফেলুদা লালমোহনবাবুকে বলল, উটের বসাটা লক্ষ করলেন তো? সামনের পা দুটো প্রথমে দুমড়ে শরীরের সামনের দিকটা আগে মাটিতে বসছে। তারপর পেছন। আর ওঠার সময় কিন্তু হবে ঠিক উলটাটা। আগে উঠবে পিছন দিকটা, তারপর সামনেটা। এই হিসেবটা মাথায় রেখে শরীরটা আগু-পিছু করে নেবেন, তা হলে আর কোনও কেলেঙ্কারি হবে না।
কেলেঙ্কারি? জটায়ুর গলা কাঠ।
দেখুন, ফেলুদা বলল, আমি আগে উঠছি। ফেলুদা উটের পিঠে চাপল। উটওয়ালাদের মধ্যে একজন মুখ দিয়ে একটা আওয়াজ করতেই ঠিক যে রকমভাবে ফেলুদা বলেছিল, সেইভাবে উটটা তেরেকেঁকে ভীষণ একটা ল্যাগব্যাগে ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। এটা বুঝতে পারলাম যে, ফেলুদার বেলা কোনও কেলেঙ্কারি হল না।
তোপসে ওঠ। তোরা হালকা মানুষ, তোদের ঝামেলা অনেক কম।
উটওয়ালারা দেখি বাবুদের কাণ্ড দেখে দাঁত বার করে হাসছে। আমিও সাহস করে উঠে পড়লাম, আর সেই সঙ্গে উটটাও উঠে দাঁড়াল। বুঝলাম যে আসল গোলমালটা হচ্ছে এই যে, পিছনের পা-টা যখন খাড়া হয়, সওয়ারির শরীরটা তখন এক ঝটিকায় সামনের দিকে অনেকখানি এগিয়ে যায়। মনে মনে ঠিক করলাম যে, এর পরে যদি কখনও উঠি তা হলে প্রথম দিকে শরীরটাকে পিছনে হেলিয়ে টান করে রাখব, তা হলে ব্যালেন্সটা ঠিক হবে।
জয় ম্যা—
লালমোহনবাবুর মা-টা ম্যা হয়ে গেল এই কারণেই যে, তিনি কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই উটের পিছন দিকটা এক ঝটিকায় উঁচু হয়ে গেল, যার ফলে তিনি খেলেন এক রাম-হুমড়ি। আর তারপরেই উলটো হ্যাঁচকায় হেঁইক করে এক বিকট শব্দ করেই ভদ্রলোক একেবারে পারপেণ্ডিকুলার।
গুরুবচন সিং-এর কাছে বিদায় নিয়ে আমরা তিন বেদুইন রামদেওরা স্টেশনের উদ্দেশে যাত্রা করলাম।
আধা ঘণ্টে মে আট মিল যান হ্যাঁয়, টিরেন পাকড়ন হ্যাঁয়, ফেলুদা উটওয়ালাদের উদ্দেশ করে হাঁক দিল। কথাটা শুনে একজন উটওয়ালা আরেকটা উটের পিঠে চড়ে খচুমাচু খচুমাচু করে সামনে এগিয়ে গেল। তারপর অন্য লোকটার মুখ দিয়ে হেঁই হেঁই করে কয়েকটা শব্দ বেরোতেই শুরু হল উটের দৌড়।
নড়বড়ে জানোয়ার, দৌড়ের সঙ্গে সঙ্গে শরীরটা ঝাঁকুনিও খায় রীতিমতো, কিন্তু তাও ব্যাপারটা আমার মোটেই খারাপ লাগছিল না। আর তা ছাড়া বালি আর সাদা ঝলসানো ঘাসের ওপর দিয়ে ছুটে চলেছি, জায়গাটাও রাজস্থান—সব মিলিয়ে বেশ একটা রোমাঞ্চই লাগছিল।
ফেলুদা আমার চেয়ে খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিল। লালমোহনবাবু আমার পিছনে। ফেলুদা এক বার ঘাড়টা পিছনে ফিরিয়ে হাঁক দিল—
শিপ অফ দ্য ডেজার্ট কী রকম বুঝছেন মিস্টার গাঙ্গুলী?
আমিও এক বার মাথা ঘুরিয়ে দেখে নিলাম লালমোহনবাবুর অবস্থাটা। খুব শীত লাগলে লোকে যেমন মুখ করে–তলার ঠোঁট ফাঁক হয়ে দেখা যায় দাঁতে দাঁত লেগে রয়েছে, আর গলার শিরাগুলো সব বেরিয়ে আসে–লালমোহনবাবুর দেখি সেই রকম অবস্থা।
কী মশাই? ফেলুদা হাঁকল, কিছু বলছেন না যে?