ভদ্রলোক একটা বইয়ের পাতা উলটে-পালটে দেখে বললেন, আটটায় একটা প্যাসেঞ্জার আছে, সেটা বারমের যায়। নটায় আছে রেওয়ারি প্যাসেঞ্জার। দ্যাট্স অল।
ফেলুদা কাউন্টারের উপর ডান হাতের আঙুলের ডগা দিয়ে কয়েকবার অসহিষ্ণুভাবে টাকা দিয়ে বলল, জয়সলমীর তো এখান থেকে প্রায় দুশো মাইল, তাই না?
আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনি অনুগ্রহ করে একটা ট্যাক্সির বন্দোবস্ত করে দেবেন? আমরা সাড়ে এগারোটা নাগাত বেরোতে চাই।
ভদ্রলোক সম্মতি জানিয়ে টেলিফোন তুললেন।
কোথায় চললেন আপনারা?
মন্দার বোস। স্নানটান করে ফিটফট হয়ে হাতে সুটকেস নিয়ে বেরিয়েছেন ঘর থেকে।
ফেলুদা বলল, একটু থর মরুভূমিটা দেখার ইচ্ছে আছে।
ও, তার মানে নর্থ-ওয়েস্ট। আমি যাচ্ছি একটু ইস্টে।
আপনিও চললেন?
মাই ট্যাক্সি শুড বি হিয়ার এনি মিনিট নাউ। বেশি দিন এক জায়গায় মন টেকে না। মশাই। আর আপনারাও যদি চলে যান, তা হলে তো সার্কিট হাউস খালি হয়ে যাচ্ছে এমনিতেও।
কাউন্টারের ভদ্রলোক কথা শেষ করে টেলিফোনটা নামিয়ে রেখে বললেন, ইট্ৰস অ্যারেঞ্জড্।
ফেলুদা একবার আমাকে বলল, দ্যাখ তো লালমোহনবাবুর দেখা পাস কিনা। বল যে, আমার এগারোটায় জয়সলমীর যাচ্ছি। যদি উনি আসতে চান আমাদের সঙ্গে, তা হলে যেন ইমিডিয়েটলি তৈরি হয়ে নেন।
আমি ছুটিলাম দশ নম্বর ঘরের দিকে। কী উদ্দেশ্যে যে জয়সলমীর যাচ্ছি, জানি না। ফেলুদা অন্য সব জায়গা ফেলে এ জায়গাটা বাছল কেন? বোধ হয় মরুভূমির কাছে বলে! ডক্টর হাজরাও কি জয়সলমীর গেছেন? এই কি আমাদের বিপদের শেষ? না এই সবে শুরু?
০৮. যোধপুর থেকে পোকরান
যোধপুর থেকে পোকরান প্রায় একশো কুড়ি মাইল রাস্তা। সেখান থেকে জয়সলমীর আবার সত্তর মাইল। সবসুদ্ধ এই দুশো মাইল যেতে আন্দাজ সাড়ে ছ সাত ঘণ্টা লাগা উচিত। অন্তত আমাদের ড্রাইভার গুরুবচন সিং তাই বলল। বেশ গোলগাল হাসিখুশি শিখ ড্রাইভারটিকে লক্ষ করছিলাম মাঝে মাঝে স্টিয়ারিং থেকে হাত দুটো সরিয়ে নিয়ে মাথার পিছনে দিয়ে শরীরটা পিছন দিকে হেলিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। গাড়ি অবশ্য তখনও চলছে, আর স্টিয়ারিং ঘোরানোর কাজটা সেরে নিচ্ছে ভূড়িটাকে এগিয়ে দিয়ে। কাজটা অবিশ্যি শুনতে যত কঠিন মনে হয় ততটা নয়, কারণ প্রথমত গাড়ি চলাচল এ রাস্তায় প্রায় নেই বললেই চলে, আর দ্বিতীয়ত পাঁচ ছ মাইল ধরে একটানা সাজা রাস্তা এর মধ্যে অনেকবারই লক্ষ করলাম। পথে কোনও গোলমাল না হলে মনে হয় সন্ধ্যা ছটা নাগাদ জয়সলমীর পৌঁছে যাক।
যোধপুর ছাড়িয়ে মাইল দশেক পর থেকেই এমন সব দৃশ্য আরম্ভ হয়েছে, যেমন আমি এর আগে কখনও দেখিনি। যোধপুরের আশেপাশে অনেক পাহাড় আছে, যে সব পাহাড়ের লালচে রঙের পাথর দিয়েই যোধপুরের কেল্লা তৈরি। কিন্তু কিছুক্ষণ থেকেই মনে হচ্ছে যেন পাহাড় ফুরিয়ে গেছে। তার বদলে আরম্ভ হয়েছে দিগন্ত অবধি গড়িয়ে যাওয়া ঢেউ খেলানো জমি। এই জমির কিছুটা ঘাস, কিছুটা লালচে মাটি, কিছুটা বালি আর কিছুটা কাঁকর। সাধারণ গাছপালাও ক্রমশ কমে গিয়ে তার বদলে চোখে পড়ছে। বাবলা গাছ, আর নাম-না-জানা সব কাঁটা গাছ আর কাঁটা ঝোপ।
আর দেখছি। বুনো উট। গোরু, ছাগলের মতো উট চরে বেড়াচ্ছে যেখানে সেখানে। তার কোনওটার রং দুধ-দেওয়া চায়ের মতো, আর কোনওটা আবার ব্ল্যাক কফির কাছাকাছি। একটা উটকে দেখলাম। ওই শুকনো কাঁটা গাছই চিবিয়ে খাচ্ছে। ফেলুদা বলল, কাঁটা গাছ খেয়ে নাকি অনেক সময় ওদের মুখের ভিতরটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। কিন্তু এ সব অঞ্চলে এটাই ওদের খাদ্য বলে ওরা নাকি সেটা গ্রাহ্যই করে না।
জয়সলমীরের কথাও ফেলুদা বলছিল। দ্বাদশ শতাব্দীতে তৈরি এই শহর নাকি ভাটি রাজপুতদের রাজধানী ছিল। ওখান থেকে মাত্র চৌষট্টি মাইল দূরে পাকিস্তানের বন্ডার। দশ বছর আগেও নাকি জয়সলমীরে যাওয়া খুব মুশকিল ছিল। ট্রেন তো ছিলই না, রাস্তাও যা ছিল, তা অনেক সময়ই বালিতে ঢাকা পড়ে হারিয়ে যেত। জায়গাটা নাকি এত শুকনো যে ওখানে বছরে একদিন বৃষ্টি হলেও লোকেরা সেটাকে সৌভাগ্য বলে মনে করে। যুদ্ধের কথা জিজ্ঞেস করতে ফেলুদা বলল যে আলাউদ্দীন খিলজি নাকি একবার জয়সলমীর আক্রমণ করেছিল।
নব্বই কিলোমিটার বা ছাপন্ন মাইলের কাছাকাছি এসে হঠাৎ আমাদের ট্যাক্সির একটি টায়ার পাংচার হয়ে গাড়িটা একটা বিশ্ৰী শব্দ করে রাস্তার একপাশে কেতরে থেমে গেল। গুরুবচন সিং-এর উপর মনে মনে বেশ রাগ হল। ও বলেছিল টায়ার চেক করে নিয়েছে, হাওয়া দেখে নিয়েছে ইত্যাদি। সত্যি বলতে কী, গাড়িটা বেশ নতুনই।
সদরজির সঙ্গে সঙ্গে আমরাও বাইরে বেরেলাম। টায়ার চেঞ্জ করার হ্যাঁঙ্গাম আছে, অস্তুত পনেরো মিনিটের ধাক্কা।
চ্যাপটা টায়ারের দিকে চোখ যাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমরা পাংচারের কারণটা বুঝতে পারলাম।
রাস্তার অনেকখানি জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে আছে অজস্র পেরেক। সেগুলো দেখেই বোঝা যায় যে, সদ্য কেনা হয়েছে।
আমরা এ-ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। সিং সাহেব দাঁতের ফাঁক দিয়ে একটা কথা বলল, যেটা অবিশ্যি বইয়ে লেখা যায় না। ফেলুদা কিছুই বলল না, শুধু কোমরে হাত দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে ভাবতে লাগল। লালমোহনবাবু একটা পুরনো জাপান এয়ার লাইনসের ব্যাগ থেকে একটা ডায়েরি ধরনের সবুজ খাতা বার করে তাতে খসখস করে পেনসিল দিয়ে কী জানি লিখলেন।