কোত্থেকে আসছেন?
আজ্ঞে, আমি আসছি। সেই শ্যামবাজার থেকে।
ভেতরে আসুন।
ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে এলেন।
বসুন। আমিই প্রদোষ মিত্তির।
ওঃ! আপনি এত ইয়ং সেটা আমি ঠিক…
ভদ্রলোক গদগদ ভাব করে সোফার পাশের চেয়ারটায় বসে পড়লেন। তাঁর হাসি কিন্তু বসার পরেই মিলিয়ে গেল!
কী ব্যাপার? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
ভদ্রলোক গলা খাকরিয়ে বললেন, কৈলাস চৌধুরী মশায়ের কাছ থেকে আপনার অনেক সুখ্যাতি শুনেছি। তিনি, মানে, আমার একজন খদ্দের আর কী। আমার নাম সুধীর ধর। আমার একটা বইয়ের দোকান আছে কলেজ স্ট্রিটে–ধর অ্যান্ড কোম্পানি–দেখে থাকতে পায়েন হয়তো।
ফেলুদা ছোট্ট করে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে দিল। তারপর আমায় বলল, তোপসে–জানলাটা বন্ধ করে দে তো।
রাস্তার দিকের জানালাটা বন্ধ করতে গানের আওয়াজটা একটু কমল আর তার ফলে ভদ্রলোকও আরেকটু স্বাভাবিকভাবে বাকি কথাগুলো বলতে পারলেন।
দিন সাতেক আগে খবরের কাগজে একটা খবর বেরিয়েছিল আমার ছেলের বিষয়ে–আপনি কি?
কী খবর বলুন তো?
ওই জাতিস্মর…মানে…
ওই মুকুল বলে ছেলেটি?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
খবরটা তা হলে সত্যি?
মানে, ও আপনার যে ধরনের কথাবার্তা বলে তাতে তো…
জাতিস্মর ব্যাপারটা আমি জানতাম। এক-একজন থাকে, তাদের নাকি হঠাৎ পূৰ্ব্বজন্মের কথা মনে পড়ে যায়। তাদের বলে জাতিস্মর।
অবিশ্যি পূৰ্ব্বজন্ম বলে কিছু আছে কি না সেটা ফেলুদাও নাকি জানে না।
ফেলুদা চারমিনারের প্যাকেটটা খুলে ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে দিল। ভদ্রলোক একটু হেসে মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিলেন তিনি খান না। তারপর বললেন, বোধহয় মনে থাকবে, আমার এই ছেলেটি–আট বছর মাত্র বয়স–একটা জায়গার বর্ণনা দেয়, সেখানে নাকি সে গেছে। অথচ তেমন জায়গায়—আমার ছেলে তো দূরের কথা-আমার বা আমার পূর্বপুরুষদের কারুর কখনও যাবার সৌভাগ্য হয়নি। ছা-পোষা লোক, বুঝতেই তো পারছেন। দোকান দেখি, এদিকে বইয়ের বাজার দিনে দিনে–
একটা দুর্গের কথা বলে না আপনার ছেলে? ফেলুদা ভদ্রলোককে কতকটা বাধা দিয়েই বলল।
আজ্ঞে হ্যাঁ। বলে—সোনার কেল্লা। তার মাথায় কামান বসানো আছে, যুদ্ধ হচ্ছে, লোক মরছে—সে সব নাকি সে দেখেছে। সে নিজে পাগড়ি পরে উটের পিঠে চড়ে বলির উপর বেড়াত। বালির কথা খুব বলে। হাতি ঘোড়া এ সব অনেক কিছু বলে। আবার, ময়ূরের কথা বলে। ওর হাতে একটা দাগ আছে কনুইয়ের কাছে। সেটা জন্মে অবধি আছে–আমরা তো জন্মদাগ বলেই জানতাম। ও বলে যে একবার নাকি একটা ময়ূর ওকে ঠোকর মেরেছিল, এটা নাকি সেই ঠোকারের দাগ।
কোথায় থাকত সেটা পরিষ্কার ভাবে বলে?
না–তবে তার বাড়ি থেকে নাকি সোনার কেল্লা দেখা যেত। মাঝে মাঝে কাগজে হিজিবিজি কাটে পেনসিল দিয়ে। বলে–এই দ্যাখো আমার বাড়ি। দেখে তো বাড়ির মতোই মনে হয়।
বই-টইয়ের মধ্যে এমন কোনও জায়গার ছবি সে দেখে থাকতে পারে না? আপনার তো বইয়ের দোকান আছে…
তা অবিশ্যি পারে। কিন্তু ছবির বই তো অনেক ছেলেই দেখে-তাই বলে কি তারা অষ্টপ্রহর এইভাবে কথা বলে? আপনি আমার ছেলেকে দেখেননি। তাই; সত্যি বলতে কী–তার মনটাই যেন পড়ে আছে অন্য কোথাও। নিজের বাড়ি, নিজের ভাই-বোন বাপ-মা আত্মীয়স্বজন-এর কোনওটাই যেন তার আপনি নয়। আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে কথাই বলে না সে ছেলে।
কবে থেকে এই সব বলতে শুরু করেছে? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
তা মাস দুয়েক। ওই ছবি আঁকা দিয়েই শুরু, জানেন। সেদিন খুব জল হয়েছে, আমি দোকান থেকে সবে ফিরিচি, আর সে আমায় এসে ছবি দেখাচ্ছে। গোড়ায় গা করিনি। ছেলেবিয়সে তো কত রকম পাগলামিই থাকে! কনের কাছে ভ্যানর ভ্যানর করেছে, কান পাতিনি। আমার গিন্নিই প্রথম খেয়াল করে। তারপর কদিন ধরে তার কথা শুনে-টুনে, তার হাবভাব দেখে, আমার আরেক খদ্দের আছে–নাম শুনেছেন কি?–ডাক্তার হেমাঙ্গ হাজরা…
হ্যাঁ হ্যাঁ। প্যারাসাইকলজিস্ট। শুনেছি বইকী। তা তিনি তো আপনার ছেলেকে নিয়ে বাইরে কোথায় যাবেন বলে কাগজে বেরিয়েছে।
যাবেন না, চলে গেছেন অলরেডি। তিনদিন এলেন আমার বাড়িতে। বললেন, এ তো রাজপুতানার কথা বলছে বলে মনে হচ্ছে। আমি বললুম হতে পারে। শেষটায় বলেন কী, তোমার ছেলে জাতিস্মর; এই জাতিস্মর নিয়ে আমি রিসার্চ করছি। আমি তোমার ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে রাজপুতানায় যাব। ঠিক জায়গায় গিয়ে ফেলতে পারলে তোমার ছেলের নিশ্চয়ই আরও অনেক কথা মনে পড়বে। তাতে আমার খুব সুবিধে হবে। ওর খরচও আমি দেব, খুব যত্নে রাখব, তোমার কিছু ভাবতে হবে না।
তারপর? ফেলুদার গলার স্বর আর তার এগিয়ে বসার ভঙ্গিতে বুঝলাম সে বেশ ইন্টারেস্ট পেয়েছে!
তারপর আর কী–মুকুলকে নিয়ে চলে গেলেন!
ছেলে আপত্তি করেনি?
ভদ্রলোক একটা শুকনো হাসি হেসে বললেন, কোথায় আছেন। আপনি? যেই বললে সোনার কেল্লা দেখাবে আমনি এক কথায় রাজি হয়ে গেল। আপনি তো দেখেননি। আমার ছেলেকে। ও, মানে, ঠিক আর পাঁচটা ছেলের মতো নয়। একেবারেই নয়। রাত তিনটের সময় উঠে বসে আছে। গুন-গুন করে গান গাইছে। ফিলিমের গানটান নয়। মশাই–গোঁয়ে গাঁয়ে সুর—তবে বাংলাদেশের গাঁ নয় এটা জানি। আমি আবার একটু হারমোনিয়াম-টারমোনিয়াম বাজাই, বুঝেছেন…
ভদ্রলোক এত কথা বললেন, কিন্তু ফেলুদার কাছে কেন এলেন, গোয়েন্দার কেন প্রয়োজন হতে পারে তাঁর, সেটা এখনও পর্যন্ত কিছুই বললেন না। হঠাৎ ফেলুদার একটা কথাতেই যেন ব্যাপারটা একটা অন্য চেহারা নিয়ে নিল।