পশ্চিম দিকের ছাতটায় গিয়ে দেখি যোধপুরের কেল্লাটা দারুণ দেখাচ্ছে সেখান থেকে।
নীচে ভিখিরির গান হয়ে চলেছে। সূরটা চেনা চেনা লাগছে। কোথায় শুনেছি। এ সুর? হঠাৎ বুঝতে পারলাম, মুকুল যে সুরে গুনগুন করে, তার সঙ্গে এর খুব মিল আছে। বার বার একই সুর ঘুরে ঘুরে আসছে, কিন্তু শুনতে একঘেয়ে লাগছে না। আমি ছাতের নিচু পাঁচিলটার দিকে এগিয়ে গেলাম। এদিকটা হচ্ছে সার্কিট হাউসের পিছন দিক।
ও মা, পিছনেও যে বাগান আছে তা তো জানতাম না! আমাদের ঘরের পিছন দিকের জানালা দিয়ে একটা ঝাউ গাছ দেখা যায় বটে, কিন্তু এতখানি জায়গা জুড়ে এত রকম গাছ আছে এদিকটায়, সেটা বুঝতে পারিনি।
ঝলমলে নীল ওটা কী নড়ছে। গাছপালার পিছনে? ওহা-একটা ময়ূর। গাছের পিছনে লুকোনো ছিল শরীরের খানিকটা, তাই বুঝতে পারিনি। এবারে পুরো শরীরটা দেখা যাচ্ছে। মাটি থেকে খুঁটে খুঁটে কী যেন খাচ্ছে। পোকাটাকা বোধ হয়; ময়ূর তো পোকা খায় বলেই জানি। হঠাৎ মনে পড়ল কোথায় যেন পড়েছিলাম যে, ময়ূরের বাস খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল। তারা বেছে বেছে নাকি অদ্ভুত সব গোপন জায়গা বার করে বাসা তৈরি করে।
আস্তে আস্তে পা ফেলে ময়ূরটা এগোচ্ছে, লম্বা গলাটাকে বেঁকিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে দেখছে, শরীরটা ঘুরলে সমস্ত লেজটা সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে যাচ্ছে।
হঠাৎ ময়ূরটা দাঁড়াল। গলাটা ডান দিকে ঘোরাল। কী দেখছে ময়ূরটা? নাকি কোনও শব্দ শুনেছে?
ময়ূরটা সরে গেল। কী জানি দেখে ময়ূরটা সরে যাচ্ছে।
একজন লোক। আমি যেখানে দাঁড়িয়েছি, তার ঠিক নীচে। গাছের ফাঁক দিয়ে ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে। লোকটার মাথায় পাগড়ি। খুব বেশি বড় না-মাঝারি। গায়ে সাদা চাদর জড়ানো। একেবারে ওপর থেকে দেখছি বলে লোকটার মুখ দেখা যাচ্ছে না। খালি পাগড়ি আর কাঁধ। হাত দুটো চাদরের তলায়।
লোকটা পা টিপে টিপে এগোচ্ছে। পশ্চিম দিক থেকে পূব দিকে। আমি রয়েছি পশ্চিমের ছাতে। পুব দিকে একতলায় আমাদের ঘর।
হঠাৎ ইচ্ছে করল লোকটা কোথায় যায় দেখি। মাঝের ঘরগুলো দৌড়ে পেরিয়ে গিয়ে উলটো দিকের ছাতের পিছনের পাঁচিলের কাছে গিয়ে সামনে ঝুকে পড়লাম।
লোকটা এখন আবার আমার ঠিক নীচে। ছাতের দিকে চাইলে আমাকে দেখতে পাবে, কিন্তু দেখল না।
এগিয়ে আসছে সামনের দিকে লোকটা; আমাদের ঘরের জানালার দিকে এগিয়ে আসছে। হাতটা চাদরের ভিতর থেকে বার করল। কবজির কাছটায় চকচকে ওটা কী?
লোকটা থেমেছে। আমার গলা শুকিয়ে গেছে। লোকটা আরেক পা এগোল–
ক্যাঁ ও য়্যাঁ!
লোকটা চমকে পিছিয়ে গেল। ময়ূরটা কৰ্কশ স্বরে ডেকে উঠেছে। আর সেই সঙ্গে সঙ্গেই আমিও চেঁচিয়ে উঠলাম–
ফেলুদা?
পাগড়ি পরা লোকটা উৰ্ধৰ্বশ্বাসে দৌড়ে যে দিক দিয়ে এসেছিল, সেদিকে অদৃশ্য হয়ে গেল, আর আমিও দুড়দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে বারান্দা দিয়ে এক নিশ্বাসে দৌড়ে গিয়ে আমাদের ঘরের দরজার মুখে ফেলুদার সঙ্গে দাড়াম করে কলিশন খেয়ে ভ্যাবাচাকা চুপ।
আমাকে ঘরে টেনে নিয়ে গিয়ে ফেলুদা বলল, কী ব্যাপার বল তো?
ছাত থেকে দেখলাম, একটা লোক, পাগড়ি পারে…তোমার জানালার দিকে আসছে…
দেখতে কী রকম? লম্বা?
জানি না. উপর থেকে দেখছিলাম তো!… হাতে একটা…
হাতে কী?
ঘড়ি…
আমি ভেবেছিলাম ফেলুদা ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দেবে কিংবা আমাকে বোকা আর ভিতু বলে ঠাট্টা করবে। কিন্তু তার কোনওটাই না করে ও গভীরভাবে জানালাটার দিকে গিয়ে বাইরে মুখ বাড়িয়ে এদিক ওদিক দেখে নিল।
দরজায় একটা টোকা পড়ল।
কাম ইন।
বেয়ারা কফি নিয়ে ঢুকল।
সেলাম সাব।
টেবিলের উপর কফির ট্রে-টা রেখে পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা চিঠি বার করে ফেলুদাকে দিল।
মৈনেজার সা’বনে দিয়া।
বেয়ারা চলে গেল! ফেলুদা চিঠিটা পড়ে একটা হতাশার ভাব করে ধাপ করে সোফার উপর বসে পড়ল।
কার চিঠি ফেলুদা?
পড়ে দ্যাখ।
ডক্টর হাজরার চিঠি। ডক্টর হাজরার নাম লেখা প্যান্ডের কাগজে ইংরিজিতে লেখা ছোট্ট চার লাইনের চিঠি—আমার বিশ্বাস আমাদের পক্ষে আর যোধপুরে থাকা নিরাপদ নয়। আমি অন্য আরেকটা জায়গায় চললাম, সেখানে কিছুটা সাফল্যের আশা আছে মনে হয়। আপনি আর আপনার ভাইটি কেন আর মিথ্যা বিপদের মধ্যে জড়াবেন; তাই আপনাদের কাছে বিদায় না নিয়েই চললাম। আপনাদের মঙ্গল কামনা করি। –ইতি এইচ. এম, হাজরা।
ফেলুদা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, অত্যন্ত হেস্টি কাজ করেছেন ভদ্রলোক। তারপর কফি না খেয়েই সোজা চলে গেল রিসেপশন কাউন্টারে। আজ একটি নতুন ভদ্রলোক বসে আছেন সেখানে। ফেলুদা জিজ্ঞেস করল, ডক্টর হাজরা কি ফিরবেন বলে গেছেন?
না তো। উনি ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে গেছেন। ফেরার কথা তো কিছু বলেননি।
কোথায় গেছেন, সেটা আপনি জানেন?
স্টেশনে গেছেন এটাই শুধু জানি।
ফেলুদা একটুক্ষণ ভেবে বলল, জয়সলমীর তো এখান থেকে ট্রেনে যাওয়া যায়, তাই না?
আজ্ঞে হ্যাঁ। বছর দুয়েক হল ডিরেক্ট লাইন হয়েছে।
কখন ট্রেন?
রাত দশটা।
সকলের দিকে কোনও ট্রেন নেই?
যেটা আছে সেটা অর্ধেক পথ যায়, পোকরান পর্যন্ত। সেটা এই আধা ঘণ্টা হল ছেড়ে গেছে। পোকরান থেকে যদি গাড়ির ব্যবস্থা থাকে, তা হলে অবিশ্যি এ ট্রেনটাতেও জয়সলমীর যাওয়া যায়৷।
কতটা রাস্তা পোকরান থেকে?
সত্তর মাইল।
সকলে যোধপুর থেকে অন্য কী ট্রেন আছে?