লালমোহনবাবু কী জানি ভেবে বললেন, মিস্টার ট্রটার কি আপনাদের সঙ্গে যাবেন নাকি?
কেন? আপনার আপত্তি আছে?
লোকটা পাওয়ারফুলি সাসপিশাস্!
রাস্তার একধারে একটা জুতোওয়ালা বসেছে, তার চারিদিকে ঘিরে নাগরার ছড়াছড়ি। এখানকার লোকেরা এই ধরনের নাগরাই পরে। ফেলুদা জুতোগুলোর সামনে দাঁড়াল।
পাওয়ারফুল তো জানি। সাসপিশাস্ কেন? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
কাল গাড়িতে যেতে যেতে খুব বাক্তাল্লা মারছিল! বলে–ট্যাঙ্গানিকায় নাকি নেকড়ে মেরেছে নিজে বন্দুক দিয়ে। অথচ আমি জানি যে, সারা আফ্রিকার কোনও তল্লাটে নেকড়ে জানোয়ারটাই নেই। মার্টিন জনসনের বই পড়েছি আমি–আমার কাছে ধাপ্পা!
আপনি কী বললেন??
কী আর বলব? ফস করে মুখের ওপর তো লায়ার বলা যায় না! দুজনের মাঝখানে স্যান্ডউইচ হয়ে বসে আছি। আর লোকটার ছাতি দেখেছেন তো? কমপক্ষে ফাির্টফাইভ ইঞ্চেজ। আর রাস্তার দুধারে দেখচি ইয়া ইয়া মনসার ঝোপড়া-কনট্র্যাডিক্ট করলুম, আর অমনি কোলপাঁজ করে তুলে নিয়ে যদি ওই একটা ঝোপড়ার পেছনে ফেলে দিয়ে চলে যায়-ইন নো টাইম মশাই শকুনির স্কোয়াড্রন এসে ল্যান্ড করে ফিস্টি লাগিয়ে দেবে।
আপনার লাশে কটা শকুনের পেট ভরবে বলুন তো।
হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ…
ফেলুদা ইতিমধ্যে পায়ের স্যান্ডেল খুলে নাগরা পরে পায়চারি শুরু করে দিয়েছে। লালমোহনবাবু বললেন, ভেরি পাওয়ারফুল শুজ–কিনছেন নাকি?
একটা পরে দেখুন না, ফেলুদা বলল।
ভদ্রলোকের পায়ের মাপের মতো ছাট জুতো অবিশ্যি দোকানে ছিল না, তাও তার মধ্যে যে জোড়াটা সবচেয়ে ছোট, সেটা পরে তিনি প্ৰায় আঁতকে উঠলেন। এ যে গণ্ডারের চামড়া মশাই! এ তো গণ্ডার ছাড়া আর কারুর পায়ে সুট করবে না।
তা হলে ধরে নিন রাজস্থানের শতকরা নব্বই ভাগ লোক আসলে গণ্ডার। দুজনেই নাগরা খুলে যে যার জুতো পরে নিল। দাকানদারও হাসছিল। সে বুঝেছে,
আমরা এগিয়ে চললাম। একটা পানের দোকান থেকে বেদম জোরে রেডিয়োতে ফিল্মের গানের আওয়াজ বেরোচ্ছে। মনে পড়ে গেল। কলকাতার পুজো-প্যান্ডেলের কথা। এখানে পুজো নেই, আছে। দশের। কিন্তু তার এখনও অনেক দেরি।
আরও কিছুদূর এগিয়ে ফেলুদা একটা পাথরের তৈরি জিনিসের দাকানের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। দোকানটার চেহারা বেশ ভদ্র, নাম সোলাঙ্কি স্টোর্স। বাইরে কাচের জানালার পিছনে সুন্দর সুন্দর পাথরের ঘটি বাটি গেলাস পাত্ৰ সাজানো রয়েছে। ফেলুদা একদৃষ্টি সেগুলোর দিকে চেয়ে আছে। দোকানদার দরজার মুখটাতে এগিয়ে এসে আমাদের ভিতরে আসতে অনুরোধ করল।
ফেলুদা জানালার দিকে দেখিয়ে বলল, ওই বাটিটা একবার দেখতে পারি?
দোকানদার জানালার বাটিটা না বার করে ভিতরের একটা আলমারি থেকে ঠিক সেই রকমই একটা বাটি বার করে দিল। সুন্দর হলদে রঙের পাথরের বাটি। আগে কখনও এ রকম জিনিস দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
এটা কি এখানকার তৈরি? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
দোকানদার বলল, রাজস্থানেরই জিনিস, তবে যোধপুরের নয়।
তবে কোথাকার?
জয়সলমীর। এই হলদে পাথর শুধু ওখানেই পাওয়া যায়।
আই সি…
জয়সলমীর নামটা আমি আবছা শুনেছি। জায়গাটা যে রাজস্থানের ঠিক কোনখানে সেটা আমার জানা ছিল না। ফেলুদা বাটিটা কিনে নিল। সাড়ে নটা নাগাত টাঙ্গার ঝাঁকুনি খেয়ে সকালের ডিম-রুটি হজম করে আমরা সার্কিট হাউসে ফিরলাম।
মন্দার বোস বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। আমাদের হাতে প্যাকেট দেখে বললেন, কী, কিনলেন?
ফেলুদা বলল, একটা বাটি। রাজস্থানের একটা মেমেন্টো রাখতে হবে তো।
আপনার বন্ধু তো বেরোলেন দেখলাম।
কে, ডক্টর হাজরা?
নটা নাগাত বেরিয়ে যেতে দেখলাম একটা ট্যাক্সি করে।
আর মুকুল?
সঙ্গেই গেছে। বাধ হয় পুলিশে রিপোর্ট করতে গেছেন। কালকের ঘটনার পর হি মাস্ট বি কোয়াইট শেক্ন।
লালমোহনবাবু ‘প্লটটা একটু চেঞ্জ করতে হবে’ বলে তাঁর ঘরে চলে গেলেন।
ঘরে গিয়ে ফেলুদাকে জিজ্ঞেস করলাম, হঠাৎ বাটিটা কিনলে কেন ফেলুদা!
ফেলুদা সোফায় বসে বাটিটা মোড়ক থেকে খুলে টেবিলের উপর রেখে বলল, এটার একটা বিশেষত্ব আছে।
কী বিশেষত্ব?
জীবনে এই প্রথম একটা বাটি দেখলাম যেটাকে সোনার পাথরবাটি বললে খুব ভুল বলা হয় না।
এর পরে আর কোনও কথা না বলে সে ব্র্যাড্শ-র পাতা উলটাতে আরম্ভ করল। আমি আর কী করি। জানি এখন ঘণ্টাখানেক ফেলুদার মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোবে না, বা তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে তার উত্তর পাওয়া যাবে না, তাই অগত্যা বাইরে বেরেলাম।
লম্বা বারান্দাটা এখন খালি। মন্দারবাবু উঠে গেছেন। দূরে একজন মেমসাহেব বসেছিলেন, তিনিও উঠে গেছেন। একটা ঢোলকের আওয়াজ ভেসে আসছে। এবার তার সঙ্গে একটা গান শুরু হল। গেটের দিকে চেয়ে দেখলাম, দুটো ভিখিরি গোছের লোক—একটা পুরুষ আর একটা মেয়ে—গেট দিয়ে ঢুকে আমাদের বারান্দার দিকে এগিয়ে আসছে। ছেলেটা ঢোলক বাজাচ্ছে আর মেয়েটা গান গাইছে। আমি বারান্দা দিয়ে এগিয়ে গেলাম।
মাঝখানের খোলা জায়গাটায় গিয়ে ইচ্ছে হল একবার দোতলায় যাই। সিঁড়িটা প্ৰথম দিন থেকেই দেখছি, আর জানি যে উপরে ছাত আছে। উঠে গেলাম সিঁড়ি দিয়ে।
দোতলার মাঝখানে পাশাপাশি খান চারেক ঘর। সেগুলোর দু দিকে পুবে আর পশ্চিমে খোলা ছতি।| ঘরগুলোতে লোকজন নেই বলেই মনে হল। কিংবা হয়তো যারা আছে তারা বেরিয়েছে।