ওটা কার চিঠি ফেলুদা? কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম আমি।
জানি না, বলে ফেলুদা চিঠিটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। হাতে নিয়ে দেখি, সেটা ইংরেজিতে লেখা চিঠি। মাত্র একটা লাইন-বড় হাতের অক্ষরে ডট পেন দিয়ে লেখা–
ইফ ইউ ভালুইয়োর লাইফ–গো ব্যাক টু ক্যালকাটা ইমিডিয়েটলি।
অর্থাৎ তোমার জীবনের প্রতি যদি তোমার মায়া থাকে, তা হলে এক্ষুনি কলকাতায় ফিরে যাও।
আমার হাতে চিঠিটা কাঁপতে লাগল। আমি চট করে সেটা টেবিলের উপর রেখে হাত দুটোকে কোলের উপর জড়ো করে নিজেকে স্টেডি করার চেষ্টা করলাম।
কী করবে ফেলুদা?
সিলিং-এর ঘুরন্ত পাখাঁটার দিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে ফেলুদা প্রায় আপন মনেই বলল, মাকড়সার জাল…জিয়োমেট্রি…। এখন অন্ধকার… দেখা যাচ্ছে না… রোদ উঠলে জালে আলো পড়বে—-চিক্ চিক্ করবে…তখন ধরা পড়বে জালের নকশা!…এখন শুধু আলোর অপেক্ষা…
০৭. কাল মাঝরাত্তিরে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল
কাল মাঝরাত্তিরে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল একবার, তখন সময় কটা জানি না, দেখলাম ফেলুদা বেড-সাইড ল্যাম্পটা জ্বলিয়ে তার নীল খাতায় কী যেন লিখছে! ও কত রাত পর্যন্ত কাজ করেছিল জানি না। কিন্তু সকাল সাড়ে ছটায় উঠে দেখলাম, ও তার আগেই উঠে দাড়ি-টাড়ি কামিয়ে রেডি। ও বলে, মানুষের ব্রেন যখন খুব বেশি কাজ করে, তখন ঘুম আপনা থেকেই কমে যায়; কিন্তু তাতে নাকি শরীর খারাপ হয় না। অন্তত ওর তো তাই ধারণা, আর ওর শরীর গত দশ বছরে এক দিনের জন্যেও খারাপ হয়েছে বলে তো মনে পড়ে না। আমি জানতাম যে যোধপুরে এসেও ও যোগব্যায়াম বন্ধ করেনি। আজকেও জানি, আমার ঘুম ভাঙার আগেই ওর সে-কাজটা সারা হয়ে গেছে।
ডাইনিং রুমে ব্রেকফাস্ট খেতে গিয়ে সকলের সঙ্গেই দেখা হল! লালমোহনবাবু কাল রাত্রেই সার্কিট হাউসে চলে এসেছিলেন। তিনি বারান্দার পশ্চিম অংশটাতে মন্দার বোসের দুটো ঘর পরেই রয়েছেন। ভদ্রলোক ডিমের অমলেট খেতে খেতে বললেন, তাঁর নাকি চমৎকার একটা প্লট মাথায় এসেছে। ডক্টর হাজরা একদম মুষড়ে পড়েছেন; বললেন যে, রাত্ৰে নাকি তার ভাল ঘুম হয়নি। একমাত্র মুকুলই দেখলাম নির্বিকার।
মন্দার বোস আজ প্ৰথম সরাসরি ডক্টর হাজরার সঙ্গে কথা বললেন—
কিছু মনে করবেন না মশাই, আপনি যে উদ্ভট জিনিস নিয়ে রিসার্চ করছেন, তাতে এ ধরনের গণ্ডগোল হবেই। যে দেশে কুসংস্কারের এত ছড়াছড়ি, সে দেশে এ সব জিনিস বেশি না ঘটানোই ভাল। শেষকালে দেখবেন, ঘরে ঘরে সব কচি ছোকরীরা নিজেদের জাতিস্মর বলে ক্লেম করছে। তলিয়ে দেখলে দেখবেন, ব্যাপারটা আর কিছুই না, তাদের বীপেরা একটু পাবলিসিটি চাইছে, ব্যাস। তখন আপনি ঠালা সামলাবেন কী করে? কটা ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বিদেশে বিভুঁইয়ে চরে বেড়াবেন?
ডক্টর হাজরা কোনও মন্তব্য করলেন না। লালমোহনবাবু এর-ওর মুখের দিকে চাইলেন, কারণ জাতিস্মর ব্যাপারটা উনি এখনও কিছু জানেন না।
ফেলুদা আগেই বলেছিল যে, ব্রেকফাস্ট সেরে একটু বাজারের দিকে যাবে। আমি জানতাম, সেটা নিশ্চয়ই শুধু শহর দেখার উদ্দেশ্যে নয়। পৌনে আটটার সময় আমরা বেরিয়ে পড়লাম.। দুজন নয়, তিনজন। লালমোহনবাবুও আমাদের সঙ্গ নিলেন। আমি এর মধ্যে দু-একবার ভদ্রলোককে দুশমন হিসেবে কল্পনা করার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু প্রতিবারই এত হাসি পেল যে বাধ্য হয়ে সেটা মন থেকে দূর করতে হল।
সার্কিট হাউসের দিকটা নিরিবিলি আর খোলামেলা হলেও শহরটা গিজগিজে। প্রায় সব জায়গা থেকেই পুরনো পাঁচিলটা দেখা যায়। সেই পাঁচিলের গায়ে দোকানের সারি, টাঙ্গার লাইন, লোকের থাকবার বাড়ি আর আরও কত কী! পাঁচশো বছর আগেকার শহরের চিহ্ন আজকের শহরের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে।
আমরা এ-দোকান সে-দোকান দেখতে দেখতে হেঁটে চলেছি। ফেলুদা কিছু একটা খুঁজছে সেটা বুঝতে পারলাম, কিন্তু সেটা যে কী সেটা বুঝলাম না। লালমোহনবাবু হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, হাজরা কীসের ডাক্তার বলুন তো? আজ আবার টেবিলে মিস্টার ট্রটার কী-সব বলছিলেন…
ফেলুদা বলল, হাজরা একজন প্যারাসাইকলজিস্ট। প্যারাসাইকলজিস্ট? লালমোহনবাবুর ভুরু কুঁচকে গেল। সাইকলজির আগে যে আবার প্যারা বসে সেটা তো জানতুম না মশাই। টাইফয়েডের আগে বসে সেটা জানি। তার মানে কি হাফ-সাইকলজি–প্যারা-টাইফয়েড যেমন হাফ-টাইফয়েড?
ফেলুদা বলল, হাফ নয়, প্যারা মনে হচ্ছে অ্যাবনরম্যাল। মনস্তত্ত্ব ব্যাপারটা এমনই ধোঁয়াটে; তার মধ্যেও আবার যে দিকটা বেশি ধোঁয়াটে, সেটা প্যারাসাইকলজির আন্ডারে পড়ে।
আর জাতিস্মরের কথা কী যেন বলছিলেন?
মুকুল ইজ এ জাতিস্মর। অন্তত তাই বলা হয় তাকে।
লালমোহনবাবুর মুখ হাঁ হয়ে গেল।
আপনি প্লটের অনেক খোরাক পাবেন, ফেলুদা বলল, ছেলেটি পূর্ব জন্মে দেখা একটা সোনার কেল্লার কথা বলে। আর সে নাকি একটা বাড়িতে থাকত। যার মাটিতে গুপ্তধন পোঁতা ছিল।
আমরা কি সেই সবের খোঁজে যাচ্ছি নাকি মশাই? লালমোহনবাবুর গলা ঘড়ঘড়ে হয়ে গেছে।
আপনি যাচ্ছেন কি না জানি না, তবে আমরা যাচ্ছি।
লালমোহনবাবু রাস্তার মাঝখানে দু হাত দিয়ে খপ করে ফেলুদার হাত ধরে ফেলল।
মশাই–চানস্ অফ এ লাইফটাইম। আমায় ফেলে ফস করে কোথাও চলে যাবেন না–এইটেই আমার রিকোয়েস্ট।
এর পরে কোথায় যাব এখনও কিছুই ঠিক হয়নি।