ভদ্রলোক পকেট থেকে একটা খাম বার করে ফেলুদাকে দিলেন। তাতে টিকিট নেই। বোঝাই যায় কোনও স্থানীয় লোক সেটা দিয়ে গেছে।
ফেলুদা চিঠি খুলতে খুলতে বলল, আপনাকে কে দিল?
আমরা যখন বেরোচ্ছি, তখন বাগরি বলে যে ছোকরাটা রিসেপশনে বসে, সেই দিল। বললে কে কখন রেখে গেছে জানে না।
ফেলুদা এক্সকিউজ মি বলে চিঠিটা পড়ে আবার খামে পুরে পকেটে রেখে দিল। তাতে কী লেখা আছে কিছুই বুঝতে পারলাম না, জিজ্ঞেসও করতে পারলাম না।
আরও আধঘণ্টা ঘোরার পর ফেলুদা ঘড়ি দেখে বলল, এবার সার্কিট হাউসে যেতে হয়। কেল্লাটা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না, কিন্তু উপায় নেই।
কেল্লার বাইরে দুটো ট্যাক্সিই দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঠিক হল যে এবার আমরা এক সঙ্গেই ফিরুব। যখন ট্যাক্সিতে উঠছি, তখন ড্রাইভার বলল ডক্টর হাজরারা, নাকি সার্কিট হাউসে যাননি। উয়ো যো লোড়কা থা–ও নাকি বলেছে সার্কিট হাউসে যাবে না।
তবে কোথায় গেছে ওরা? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
তাতে ড্রাইভার বলল, ওরা গেছে দেবী কুণ্ডে। সেটা আবার কী জায়গা? ফেলুদা বলল, ওখানে নাকি রাজপুত যোদ্ধাদের স্মৃতিস্তম্ভ আছে।
পাঁচ মাইল পথ, যেতে লাগল দশ মিনিট। জায়গাটা সত্যিই সুন্দর, আর তেমনি সুন্দর স্মৃতিস্তম্ভগুলো। পাথরের বেদির উপর পাথরের থাম, তার উপর পাথরের ছাউনি, আর মাথা থেকে পা অবধি সুন্দর কারুকার্য। এই রকম স্মৃতিস্তম্ভ চারদিকে ছড়ানো রয়েছে কমপক্ষে পঞ্চাশটা। সমস্ত জায়গাটা গাছপালায় ভর্তি, সেই সব গাছে টিয়ার দল জটলা করছে, এ-গাছ থেকে ও-গাছ ফুরুৎ ফুরুৎ করে উড়ে বেড়াচ্ছে আর ট্যাঁ ট্যা করে ডাকছে। এত টিয়া একসঙ্গে আমি কখনও দেখিনি।
কিন্তু ডক্টর হাজরা কোথায়? আর কোথায়ই বা মুকুল?
লালমোহনবাবুর দিকে চেয়ে দেখি, উনি উশখুশ করছেন। বললেন, ভেরি সাসপিশাস্ অ্যান্ড মিস্টিরিয়াস।
ডক্টর হাজরা! মন্দার বোস হঠাৎ এক হাঁকি দিয়ে উঠলেন। তাঁর ভারী গলার চিৎকারে এক ঝাঁক টিয়া উড়ে পালাল, কিন্তু ডাকের কোনও সাড়া পাওয়া গেল না।
আমরা কজনে খুঁজতে আরম্ভ করে দিলাম! স্মৃতিস্তম্ভে স্মৃতিস্তম্ভে জায়গািটা প্রায় একটা গোলকধাঁধার মতো হয়ে রয়েছে। তারই মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে ফেলুদাকে দেখলাম। ঘাস থেকে একটা দেশলাইয়ের বাক্স কুড়িয়ে নিয়ে পকেটে পূরল।
শেষকালে কিন্তু লালমোহনবাবুই আবিষ্কার করলেন ডক্টর হাজরাকে। তাঁর চিৎকার শুনে আমরা দৌড়ে গিয়ে দেখি, একটা আমগাছের ছায়ায় শেওলা-ধরা বেদির সামনে মুখ আর হাত। পিছন দিকে বাঁধা অবস্থায় মাটিতে কুঁকড়ে পড়ে আছেন ডক্টর হাজরা। তাঁর মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত অসহায় গোঁ গোঁ শব্দ বেরোচ্ছে।
ফেলুদা হুমড়ি খেয়ে ভদ্রলোকের উপর পড়ে তাঁর হাতের বাঁধন আর মুখের গ্যাগ খুলে দিল। দেখেই মনে হল যেটা দিয়ে বাঁধা হয়েছে সেটা একটা পাগড়ি থেকে ছেড়া কাপড়।
মন্দার বোস বললেন, ব্যাপার কী মশাই, এমন দশা হল কী করে?
সৌভাগ্যক্রমে ডক্টর হাজরা জখম হননি। তিনি মাটিতে ঘাসের উপরে বসে কিছুক্ষণ হাঁপালেন। তারপর বললেন, মুকুল বলল, সার্কিট হাউসে যাবে না। অগত্যা গাড়ি করে ঘুরতে লাগলাম। এখানে এসে তার জায়গাটা ভাল লেগে গেল। বলল—এগুলো ছত্রী। এগুলো আমি জানি। আমি নেবে দেখব। —নমলাম। ও এদিক ওদিক ঘুরছিল, আমি একটু গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়েছিলাম। এমন সময় পেছন থেকে আক্ৰমণ। হাত দিয়ে মুখটা চেপে মাটিতে উপুড় করে ফেলে হাঁটুটা দিয়ে মাথাটা চেপে রেখে হাত দুটো পিছনে বেঁধে ফেলল। তারপর মুখে ব্যান্ডেজ।
মুকুল কোথায়? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল। তার গলার স্বরে উৎকণ্ঠা।
জানি না। একটা গাড়ির আওয়াজ পেয়েছিলাম বটে আমাকে বাঁধবার কিছুক্ষণ পরেই।
লোকটার চেহারাটা দেখেননি? ফেলুদা প্রশ্ন করল।
ডক্টর হাজরা মাথা নাড়লেন। তবে স্ট্রাগল-এর সময় তার পোশাকের একটা আন্দাজ পেয়েছিলাম। স্থানীয় লোকের পোশাক। প্যান্ট-শার্ট নয়।
দেয়ার হি ইজ! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন মন্দার বোস।
অবাক হয়ে দেখলাম, একটা ছত্রীর পাশ থেকে মুকুল আপনমনে ঘাস চিবাতে চিঝেতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। ডক্টর হাজরা একটা হাঁপ ছাড়ার শব্দ করে থ্যাঙ্ক গড বলে মুকুলের দিকে এগিয়ে গেল।
কোথায় গিয়েছিলে মুকুল?
কোনও উত্তর নেই।
কোথায় ছিলে তুমি এতক্ষণ? ও
ইটার পিছনে। মুকুল আঙুল দিয়ে একটা ছত্রীর দিকে দেখাল।
ও রকম বাড়ি আমি দেখেছি।
ফেলুদা বলল, যে লোকটা এসেছিল তাকে তুমি দেখেছিলে?
কোন লোকটা?
ডক্টর হাজরা বললেন, ওর দেখার কথা নয়। এখানে এসেই ও দৌড়ে এক্সপ্লোর করতে চলে গেছে। বিকনিরে এসে এ রকম যে একটা কিছু ঘটতে পারে সেটাও ভাবিনি, তাই আমিও ওর জন্য চিন্তা করিনি।
তা সত্ত্বেও ফেলুদা আবার প্রশ্ন করল, তুমি দেখোনি লোকটাকে-যে ডক্টর হাজরার হাত-মুখ বাঁধল?
আমি সোনার কেল্লা দেখব।
বুঝলাম মুকুলকে কোনও প্রশ্ন করা বৃথা। ফেলুদা হঠাৎ বলল, আর টাইম ওয়েস্ট করে লাভ নেই। একদিক দিয়ে ভালই যে মুকুল আপনার সঙ্গে বা আপনার কাছাকাছি ছিল না। থাকলে হয়তো তাকে নিয়েই উধাও হত লোকটা। যদি সে লোক যোধপুর ফিরে গিয়ে থাকে তা হলে যথেষ্ট স্পিডে গাড়ি চালালে হয়তো এখনও তাকে ধরা যাবে।
দু। মিনিটের মধ্যে আমরা গাড়িতে উঠে রওনা হয়ে গেলাম। লালমোহনবাবু এবার আমাদের সঙ্গে এলেন? বললেন, ও লোকগুলো বডড ড্রিংক করে। আমার আবার মদের গন্ধ সহ্য হয় না।