দুর্গের গেটের সামনে গিয়ে ট্যাক্সি থামার সঙ্গে সঙ্গেই মুকুল বলে উঠল, এখানে কেন থামলে?
ডক্টর হাজরা বললেন, কেল্লাটা কি চিনতে পারছ মুকুল?
মুকুল গম্ভীর গলায় বলল, না। এটা বিচ্ছিরি কেল্লা। এটা সোনার কেল্লা না।
আমরা সবাই গাড়ি থেকে নেমে বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম। মুকুলের কথাটা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই কেথেকে জানি একটা কৰ্কশ আওয়াজ শোনা গেল আর তৎক্ষণাৎ মুকুল দৌড়ে এসে ডক্টর হাজরাকে দু হাতে জড়িয়ে ধরল। আওয়াজটা এল কেল্লার উলটাদিকের পার্কটা থেকে।
ফেলুদা বলল, ময়ূরের ডাক। এ রকম আগেও হয়েছে কি?
ডক্টর হাজরা মুকুলের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, কাল যোধপুরেই হয়েছিল। হি কান্ট স্ট্যান্ড পিকক্স।
মুকুল দেখলাম ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সে আবার সেই গভীর অথচ মিষ্টি গলায় বলল, এখানে থাকব না।
ডক্টর হাজরা ফেলুদাকে উদ্দেশ করে বললেন, আমি বরং গাড়িটা নিয়ে এখানকার সার্কিট হাউসে গিয়ে অপেক্ষা করছি। আপনার অ্যাদুর এসেছেন, একটু ঘুরেটুরে দেখে নিন। আমি গিয়ে গাড়িটা ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনাদের দেখা হলে সার্কিট হাউসে চলে আসবেন। তবে দুটোর বেশি দেরি করবেন না। কিন্তু, তা হলে ওদিকে ফিরতে রাত হয়ে যাবে।
ডক্টর হাজরার উদ্দেশ্য সফল হয়নি ঠিকই, কিন্তু আমার তাতে বিশেষ দুঃখ নেই। এই প্রথম একটা রাজপুত কেল্লার ভিতরটা দেখতে পাব ভেবেই আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল।
কেল্লার গেটের দিকে যখন এগোচ্ছি তখন ফেলুদা আচমকা থমকে দাঁড়িয়ে আমার কাঁধে একটা চাপ দিয়ে বলল, দেখলি?
বললাম, কী জিনিস?
সেই লোকটা।
বুঝলাম ফেলুদা সেই লাল জামা-পরা লোকটার কথা বলছে। কিন্তু ও যেদিকে তাকিয়ে রয়েছে, সেদিকে কোনও লাল জামা দেখতে পেলাম না। অবিশ্যি লোকজন অনেক রয়েছে। কারণ কেল্লার গেটের বাইরেটা একটা ছোটখাটো বাজার। বললাম, কোথায় লোকটা?
ইডিয়ট। তুই বুঝি লাল জামা খুঁজছিস?
তবে কোন লোকের কথা বলছি তুমি?
তোর মতো বোকচন্দর দুনিয়ায় নেই। তুই শুধু জামাই দেখেছিস, আর কিছুই দেখিসনি। ইন্ট ওয়াজ দ্য সোম ম্যান, চাদর দিয়ে নাক অবধি ঢাকা। কেবল আজ পরেছিল নীল জামা। আমরা যখন বেদেদের দেখতে নেমেছিলাম, সেই সময় একটা ট্যাক্সি যেতে দেখি বিকনিরের দিকে। তাতে দেখেছিলাম এই নীল জামা।
কিন্তু এখানে কী করছে লোকটা?
সেটা জানলে তো অর্ধেক বাজি মাত হয়ে যেত।
লোকটা উধাও। মনে একটা উত্তেজনার ভাব নিয়ে কেল্লার বিশাল ফটক দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। ঢুকেই একটা বিরাট চাতাল, সেটার ডানদিকে বুকের ছাতি ফুলিয়ে কেল্লাটা দাঁড়িয়ে আছে। দেয়ালের খোপরে খোপরে পায়রার বাসা। বিকানির নাকি হাজার বছর আগে একটা সমৃদ্ধ শহর ছিল, যেটা বহুকাল হল বালির তলায় তলিয়ে গেছে। ফেলুদা বলল যে, কেল্লাটা চারশো বছর আগে রাজা রায় সিং প্রথম তৈরি করতে শুরু করেন। ইনি নাকি আকবরের একজন বিখ্যাত সেনাপতি ছিলেন।
আমার মনের ভিতরটা কিছুক্ষণ থেকে খচখচ করছে একটা কথা ভেবে। লালমোহনবাবুরা এখনও এলেন না কেন? তাদের কি তা হলে রওনা হতে দেরি হয়েছে? নাকি রাস্তায় গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে? যাক গে। ওদের কথা ভেবে আশ্চর্য ঐতিহাসিক জিনিস দেখার আনন্দ নষ্ট করব না।
যে জিনিসটা সবচেয়ে অদ্ভুত লাগল সেটা হল কেল্লার অস্ত্রাগার। এখানে যে শুধু অস্ত্রই রয়েছে তা নয়, আশ্চর্য সুন্দর একটা রুপোর সিংহাসনও রয়েছে, যার নাম আলম আম্বালি। এটা নাকি মোগল বাদশাহদের উপহার। এ ছাড়া রয়েছে। যুদ্ধের বর্ম শিরস্ত্ৰাণ ঢাল তলোয়ার বল্লম ছোরা-আরও কত কী! এক-একটা তলোয়ার এত বিরাট আর এত তাগড়াই যে দেখলে বিশ্বাসই হয় না সেগুলো মানুষে হাতে নিয়ে চালাতে পারে। এগুলো দেখে জটায়ুর কথা যেই মনে পড়েছে, আমনি দেখি আমার টেলিপ্যাথির জোরে ভদ্রলোক হাজির। বিরাট কেল্লার বিরাট ঘরের বিরাট দরজার সামনে তাকে আরও খুদে আর আরও হাস্যকর মনে হচ্ছে।
লালমোহনবাবু আমাদের দেখতে পেয়ে এক গাল হেসে চারিদিকে চেয়ে শুধু বললেন, রাজপুতরা কি জায়েন্ট ছিল নাকি মশাই। এ জিনিস তো মানুষের হাতে ব্যবহার করার জিনিস নয়!
যা ভেবেছিলাম। তাই। সত্তর কিলোমিটারের মাথায় ওদের ট্যাক্সির একটা টায়ার পাংচার হয়। ফেলুদা বলল, আপনার সঙ্গের আর দুজন কোথায়?
ওরা বাজারে কী সব কিনতে লেগেছে। আমি আর থাকতে না পেরে ঢুকে পড়লুম। আমরা ফুলমহল, গজমন্দির, শিশমহল আর গঙ্গানিবাস দেখে যখন চিনি বুর্জে পৌঁছেছি, তখন মন্দার বোস আর মিস্টার মাহেশ্বরীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তাঁদের হাতে খবরের কাগজের মোড়ক দেখে বুঝলাম তাঁরা কেনাকাটা করেছেন। মন্দার বোস বললেন, ইউরোপে মধ্যযুগের দুর্গ টুর্গগুলোতে যে অস্ত্র দেখেছি, আর এখানেও যা দেখলাম, তাতে একটা জিনিসই প্রমাণ করে; মানুষ জাতটা দিনে দিনে দুর্বল হয়ে আসছে, আর আমার বিশ্বাস সেই সঙ্গে তারা আয়তনেও ছোট হয়ে আসছে।
এই আমার মতো বলছেন?? লালমোহনবাবু হেসে বললেন।
হ্যাঁ। ঠিক আপনারই মতো, মন্দার বোস বললেন, আমার বিশ্বাস আপনার ডাইমেনশনের লোক ষোড়শ শতাব্দীর রাজস্থানে একটিও ছিল না। ওহো-বই দ্য ওয়ে— মন্দারবাবু ফেলুদার দিকে ফিরলেন, আপনার জন্য এইটে এসে পড়েছিল সার্কিট হাউসে রিসেপশন ডেস্কে।