ধন্যবাদ। কাগজের রিপোর্ট দেখে আমার ধারণা অন্যরকম হয়েছিল।
ডক্টর হাজরার সঙ্গে সঙ্গে আমরাও ঘর থেকে বেরোলাম; সন্ধ্যা হয়ে গেছে। পশ্চিমের আকাশটা এখনও লাল, তবে রাস্তার বাতি জ্বলে গেছে। কিন্তু মুকুল কোথায়? বাগানে ছিল সে, কিন্তু এখন দেখছি নেই। ডক্টর হাজরা চট করে একবার নিজের ঘরে খুঁজে ব্যস্তভাবে বেরিয়ে এলেন।
‘ছেলেটা গেল কোথায়’ বলে ভদ্রলোক বারান্দা থেকে বাইরে নামলেন। আমরা তার পিছন পিছন গেলাম বাগানে। বাগানে যে নেই। সে ছেলে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
মুকুল। ডক্টর হাজরা ডাক দিলেন। মুকুল!
ও আপনার ডাক শুনেছে, ফেলুদা বলল। ও আসছে।
আবছা অন্ধকারে দেখলাম মুকুল রাস্তা থেকে গেট দিয়ে ঢুকল। আর সেই সঙ্গে দেখলাম উলটাদিকের ফুটপাথ দিয়ে একটা লোক দ্রুত হেঁটে পুবদিকে নতুন প্যালেসের দিকটায় চলে গেল। লোকটার মুখ দেখতে পারলাম না বটে, কিন্তু তার গায়ের জামার টকটকে লাল রংটা এই অন্ধকারেও স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। ফেলুদা দেখেছে কি লোকটাকে?
মুকুল এগিয়ে এল আমাদের দিকে। ডক্টর হাজরা হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে গেলেন। তারপর খুব নরম গলায় বললেন–
ওরকমভাবে বাইরে বেরোতে হয় না মুকুল?
কেন? মুকুল ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞেস করল।
অচেনা জায়গা–কতরকম দুষ্ট লোক আছে এখানে।
আমি তো চিনি।
কাকে চেন?
মুকুল হাত বাড়িয়ে রাস্তার দিকে দেখাল–
ওই যে, যে লোকটা এসেছিল।
হেমাঙ্গবাবু মুকুলের কাঁধে হাত দিয়ে ফেলুদার দিকে তাকিয়ে বললেন, দ্যাটস্ দা ট্রাবল। কাকে যে সত্যি করে চেনে আর কাকে যে পূৰ্ব্বজন্মে চিনত তা বলা মুশকিল।
লক্ষ করলাম মুকুলের হাতে কী জানি একটা কাগজের টুকরো চক চক করছে। ফেলুদাও দেখেছিল সেটা! বলল, তোমার হাতের কাগজটা একবার দেখব?
মুকুল কাগজটা দিল। একটা দু ইঞ্চি লম্বা আধা ইঞ্চি চওড়া সোনালি রাংতা।
এটা কোথায় পেলে মুকুল? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
এইখানে, বলে মুকুল ঘাসের দিকে আঙুল দেখাল।
এটা আমি রাখতে পারি? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
না। ওটা আমি পেয়েছি। সেই একই সুর। একই ঠাণ্ডা গলার স্বর। অগত্যা ফেলুদা কাগজটা ফেরত দিয়ে দিল।
ডক্টর হাজরা বললেন, চলো মুকুল, ঘরে যাই। হাত-মুখ ধুয়ে তারপর খেতে যাব আমরা। চলি মিস্টার মিত্তির। কাল ঠিক সাড়ে সাতটায় আর্লি ব্রেকফাস্ট করে বেরোচ্ছি আমরা।
খেতে যাবার আগেই ফেলুদা সুধীরবাবুকে পৌঁছ-খবর আর মুকুলের খবর দিয়ে একটা পোস্টকার্ড লিখে দিয়েছিল। স্নানটান সেরে যখন ডাইনিং রুমে পৌঁছেছি। ততক্ষণে ডক্টর হাজরা আর মুকুল ঘরে চলে গেছেন। মন্দারবাবুকে দেখলাম উলটাদিকের কোনায় সেই অবাঙালি ভদ্রলোকের সঙ্গে বসে পুডিং খাচ্ছেন। আমাদের সুপ আসতে আসতে তাঁরা উঠে পড়লেন। দরজার দিকে যাবার পথে মন্দার বোস হাত তুলে গুডিনাইট জানিয়ে গেলেন।
দুদিন ট্রেনে পথ চলে বেশ ক্লান্ত লাগছিল। ইচ্ছে ছিল, খেয়ে এসেই ঘুমিয়ে পড়ব, কিন্তু ফেলুদার জন্য একটুক্ষণ জেগে থাকতে হল। ফেলুদা তার নীল খাতা নিয়ে সিগারেট ধরিয়ে সোফায় বসেছে, আর আমি খাটে গিয়ে শুয়েছি। সঙ্গে অ্যান্টি-মশা মলম ছিল বলে আর মশারি টাঙাতে দিইনি।
ফেলুদা ডট পেনের পেছনটা টিপে নিবটা বার করে নিয়ে বলল, কার কার সঙ্গে আলাপ হল বল।
বললাম, কবে থেকে শুরু করব?
সুধীর ধরের আসা থেকে।
তা হলে প্রথমে সুধীরবাবু। তারপর শিবরতন। তারপর নীলু। তারপর শিবরতনবাবুর চাকর–
নাম কী?
মনে নেই।
মনোহর। তারপর?
তারপর জটায়ু।
আসল নাম কী?
লালমোহন।
পদবি??
পদবি..পদবি…গাঙ্গুলী।
গুড।
ফেলুদা লিখে চলেছে। আমিও বলে চললাম।
তারপর সেই লাল জামা পরা লোকটা।
আলাপ হয়েছিল তার সঙ্গে?
না—তা হয়নি–
ঠিক আছে। নেক্সট?
মন্দার বোস। আর তার সঙ্গে যে লোকটা ছিল।
আর মুকুল ধর, ডক্টর–
ফেলুদা!
আমার চিৎকারে ফেলুদার কথা থেমে গেল। আমার চোখ পড়েছে ফেলুদার বিছানার উপর। কী যেন একটা বিশ্ৰী জিনিস বালিশের তলা থেকে বেরোতে চেষ্টা করছে। আমি সেদিকে আঙুল দেখলাম।
ফেলুদা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে এসে বালিশটাকে সরিয়ে ফেলতেই একটা কাঁকড়া বিছে বেরিয়ে পড়ল। ফেলুদা বিছানার চাদরটা ধরে একটা ঝটিকা টান দিয়ে বিছেটাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে চটি দিয়ে তিনটে প্রচণ্ড চাপড় মেরে সেটাকে সাবাড় করল। তারপর একটা খবরের কাগজের টুকরো ছিড়ে নিয়ে থেতলানা বিছেটাকে তার মধ্যে তুলে বাথরুমে গিয়ে পিছনের দরজাটা খুলে কাগজটাকে পুঁটলি পাকিয়ে বাইরে ফেলে দিল। তারপর ফিরে এসে বলল, জমাদারের আসার দরজাটা খোলা ছিল, তাই এ ব্যাটা ঢুকতে পেরেছে। নে, তুই এবার ঘুমিয়ে পড়ে। কাল ভোরে ওঠা আছে।
আমার কিন্তু মোটেই অতটা নিশ্চিন্ত লাগছিল না। আমার মনে হচ্ছিল—নাঃ, থাক। যদি আমার টেলিপ্যাথির জোর থাকে, তা হলে হয়তো বিপদের কথা বেশি ভাবলেই বিপদ এসে পড়বে। তার চেয়ে ঘুমোনোর চেষ্টা করে দেখি।
০৬. পরদিন সকালে উঠে
পরদিন সকালে উঠে দাঁত-টাত মেজে য়েই ঘর থেকে বেরিয়েছি আমনি একটা চেনা গলায় শুনলাম, গুড মর্নিং বুঝলাম জটায়ু হাজির। ফেলুদা আগেই বারান্দায় বেরিয়ে বেতের চেয়ারে বসে চায়ের অপেক্ষা করছিল। লালমোহনবাবু চোখ গোল গোল করে বললেন, ওঃ–কী থ্রিলিং জায়গা মশাই! ফুল অফ পাওয়ারফুল সাসপিশাস্ ক্যারেকটারস্!