ফেলুদা একটা সিগারেট শেষ করতে না করতেই চা এসে গেল, আর বেয়ারা ঘর থেকে বেরোতে না বেরোতেই দরজায় টোকা পড়ল। ফেলুদা ভীষণ বিলিতি কায়দায় বলে উঠল, কাম ইন! পদ ফাঁক করে ভেতরে ঢুকলেন মিলিটারি গোঁফ।
ডিসটর্ব করছি না তো?
মোটেই না। বসুন। চা খাবেন?
নাঃ। এই অল্পক্ষিণ অাগেই খেয়েছি। আর ফ্র্যাংকলি স্পিকিং-চা-টা এখানে তেমন সুবিধের নয়। শুধু এখানে বলছি কেন, ভারতবর্ষ হল খাস চায়ের দেশ, অথচ কটা হাটেলে কটা ডাকবাংলোয় কটা সার্কিট হাউসে ভাল চা খেয়েছেন আপনি বলুন তো? অথচ বাইরে যান, বিদেশে যান–অ্যালবেনিয়ার মতো জায়গায় গিয়ে ভাল চা খেয়েছি জানেন? ফাস্ট ক্লাস দাৰ্জিলিং টি। আর ইওরোপের অন্য বড় শহরে তো কথাই নেই। একমাত্র খারাপ যেটা লাগে সেটা হল কাপড়ের থলিতে চায়ের পাতার ব্যাপারটা—যাকে টি-বাগস বলে। কাপে থাকবে গরম জল, আর একটা সুতো বাঁধা কাপড়ের থলিতে থাকবে চায়ের পাতা। সেইটে জলে ডুবিয়ে লিকার তৈরি করে নিতে হবে আপনাকে। তারপর তাতে আপনি দুধ দিন কি লেবু, কচলে দিন সেটা আপনার রুচি। লেমন টি-টাই আমি বেশি প্রেফার করি। তবে তার জন্যে চাই ভাল লিকার। এখানকার চা খুব অর্ডিনারি।
আপনার তো অনেক দেশ-টেশ ঘোরা আছে বুঝি? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
ওইটেই তো করেছি। সারা জীবন ধরে, ভদ্রলোক বললেন। আমি হলাম। ষাকে বলে গ্লোব-ট্রটার। তার সঙ্গে আবার শিকারের শখও আছে। সেটা অবিশ্যি আফ্রিকা থাকতেই হয়েছিল; আমার নাম মন্দার বোস।
গ্লোব-ট্রটার উমেশ ভট্টচার্যের নাম শুনেছি, কিন্তু এঁর নাম তো শুনিনি। ভদ্রলোক যেন আমার মনের কথাটা আন্দাজ করেই বললেন, অবিশ্যি আমার নাম আপনাদের শোনার কথা নয়। যখন প্রথম বেরিয়েছিলাম, তখন কাগজে নাম-টাম বেরিয়েছিল। তারপর এই ছত্রিশ বছর পরে মাস তিনেক হল সবে দেশে ফিরেছি।
সে অনুপাতে আপনার বাংলার উপর দখলটা তো ভালই আছে বলতে হবে।
দেখুন মশাই, সেটা এনটায়ারলি আপনার নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছের ওপর নির্ভর করে। আপনি যদি বিদেশে বাংলা ভুলবেন বলে ইচ্ছে করেন, তা হলে তিন মাসে ভুলে যেতে পারেন। আর তা যদি ইচ্ছে না করেন, তা হলে ত্রিশ বছরেও ভোলবার কোনও চান্স নেই। অবিশ্যি আমি আবার বাঙালির সঙ্গও পেয়েছি। যথেষ্ট। কিনিয়াতে একবার হাতির দাঁতের ব্যবসা শুরু করেছিলাম, তখন আমার সঙ্গে একটি বাঙালি ছিলেন। আমরা এক সঙ্গে ছিলাম। প্রায় সাত বচ্ছর।
সার্কিট হাউসে আপনি ছাড়া আর কেউ বাঙালি আছেন কি?
এটা অনেকবার লক্ষ করেছি, কাজে কথায় সময় নষ্ট করার লোক ফেলুদা নয়!
ভদ্রলোক বললেন, আছে। বইকী। সেটাই তো আশ্চর্য লাগছে আমার। আসলে কলকাতায় বাঙালিদের আর সোয়াস্তি নেই সেটা বেশ বুঝতে পারছি। তাই সুযোগ পেলেই এদিকে ওদিকে গিয়ে ঘুরে আসছে। অবিশ্যি দিস ম্যান হ্যাঁজ কাম উইথ এ পরিপাস্। ভদ্রলোক সাইকলজিস্ট। তবে গোলমেলে ব্যাপার বলে মনে হয়। সঙ্গে একটি ছেলে আছে। বছর আষ্টেকের, সে নাকি জাতিস্মর; পূর্বজন্মে রাজস্থানে কোন কেল্লার কাছে নাকি জন্মেছিল। ভদ্রলোক ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে সেই কেল্লা খুঁজে বেড়াচ্ছেন। ডাক্তারটি বুজরুক না ছেলেটি ধাপ্পা দিচ্ছে বোঝা শক্ত। এমনিতেও ছেলেটির হাবভাব সাস্পিশাস্। কারুর সঙ্গে ভাল করে কথা বলে না। কিছু জিজ্ঞেস করলে জবাব দেয় না। ভেরি ফিশি। অনেক তো দেখলুম ভণ্ডামি এই ত্ৰিশ বছরে, আবার এখানে এসেও যে সেই একই জিনিস দেখতে হবে তা ভাবিনি।
আপনি কি এখানেও ট্রটিং করতে এসেছেন নাকি?
ভদ্রলোক হেসে সোফা ছেড়ে উঠে পড়ে বললেন, টু টেল ইউ দ্য ট্রুথ–নিজের দেশটা ভাল করে দেখাই হয়নি এখনও। বাই দ্য ওয়ে—আপনার পরিচয়টা তো পাওয়া গেল না!
ফেলুদা নিজের আর আমার পরিচয় দিয়ে বলল, আমি আবার আমার দেশের বাইরে কোথাওই যাইনি।
আই সি। ওয়েল–সাড়ে আটটা নাগাদ যদি ডাইনিং রুমে আসেন তো আব্বার দেখা হবে। আমার আবার আর্লি টু বেড, আলি টু রাইজ…
ভদ্রলোকের সঙ্গে আমরাও দুজনে বাইরের বারান্দায় এলাম। এসে দেখলাম, গেট দিয়ে একটা ট্যাক্সি ঢুকছে। সেটা এসে সার্কিট হাউসের সামনে থামল, আর সেটা থেকে নামল একটি বছর চল্লিশের মাঝারি হাইটের ভদ্রলোক আর একটা রোগ ফরসা বাচ্চা ছেলে। বোঝাই গেল যে, এরাই হচ্ছে ডক্টর হেমাঙ্গ হাজরা এবং জাতিস্মর শ্ৰীমান মুকুল ধর।
০৫. মিস্টার বোস ডক্টর হাজরাকে গুড ইভনিং বলে
মিস্টার বোস ডক্টর হাজরাকে গুড ইভনিং বলে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। ডক্টর হাজরা ছেলেটির হাত ধরে বারান্দা দিয়ে আমাদের দিকেই এগিয়ে এসে, বোধহয় হঠাৎ দুজন অচেনা বাঙালিকে দেখে কেমন যেন একটু থতমত খেয়ে গেলেন। ফেলুদা হেসে নমস্কার করে বলল, আপনিই বোধহয় ডক্টর হাজরা?
হ্যাঁ–কিন্তু আপনাকে তো–?
ফেলুদা পকেট থেকে তার একটা কার্ড বার করে ডক্টর হাজরাকে দিয়ে বলল, আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল। সত্যি বলতে কী, আমরা আপনার খোঁজেই এসেছি। সুধীরবাবুর অনুরোধে। সুধীরবাবু একটা চিঠিও দিয়ে দিয়েছেন আপনার নামে।
ও। আই সি। মুকুল, তুমি ঘরে যাও, আমি এঁদের সঙ্গে একটু কথা বলে আসছি, কেমন?
আমি বাগানে যাব।
ছেলেটির গলা বাঁশির মতো মিষ্টি, যদিও কথাটা বলল। একেবারে ন্যাড়াভাবে, এক সুরে। প্রায় যেন একটা যন্ত্রের মানুষের ভেতর থেকে কথা বেরোচ্ছে। ডক্টর হাজরা বললেন, ঠিক আছে, বাগানে যাও, তবে লক্ষ্মী হয়ে থেকে, গেটের বাইরে যেয়ে না, কেমন?