কেন, আপনার ভাইপো–
দীননাথবাবু মুষড়ে পড়লেন।ওর কথা আর বলবেন না। ওর দায়িত্বজ্ঞানটা বড়ই কম। কোথায় যেন এক বাংলা সিনেমায় নাম লিখিয়ে অ্যাকটিং করে এসেছে। ভাবুন তো দিকি! ওর কোনও মতিস্থির নেই। না না–ও ভাইপো-টাইপো দিয়ে হবে না। আপনিই যান। আমার চেনা ট্র্যাভেল এজেন্ট আছে—আপনাদের টিকিটপত্তর সব করে দেবে। দিল্লি পর্যন্ত প্লেন, তারপর ট্রেন। যান—গিয়ে কাজটা সেরে, দিন চারেক থেকে আরাম করে আসুন। আপনার মতা গুণী লোককে এই সুযোগটুকু দিতে পারলে আমারই আনন্দ। এই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে যা করলেন— সত্যিই রিমার্কেবল।
চা এসে গিয়েছিল, আর তার সঙ্গে কিছু খাবার জিনিসও। ফেলুদা এক টুকরো চকোলেট কেক তুলে নিয়ে বলল, একটা জিনিস দেখার ভারী কৌতুহল হচ্ছে। যে নেপালি বাক্সটার মধ্যে লেখাটা পেয়েছিলেন, সেই বাক্সটা। হাতের কাছে আছে কি?
সে তো খুব সহজ। আমি বলে দিচ্ছি।
যে চাকর চা এনেছিল, সে-ই নেপালি বাক্সটা এনে দিল। এক হাত লম্বা, ইঞ্চি দশেক উচু প্ৰায়-চৌকো কাঠের বাক্সের গায়ে তামার পাত আর লাল-নীল-হলদে পাথরের কাজ করা। ডালাটা খুলতেই একটা গন্ধ পেলাম যেটা আজই আরেকবার পেয়েছি, এই কিছুক্ষণ আগেই। নরেশ পাকড়াশীর আপিসঘরের ধুলো, পুরনা ফার্নিচার আর পুরনো পর্দার কাপড় মিলিয়ে ঠিক এই একই গন্ধ।
দীননাথবাবু বললেন, এই যে দুটো তাক দেখছেন, এর উপরটাতেই ছিল খাতাটা–একটা নেপালি কাগজের মোড়কের ভেতর।
কাক্স যে দেখছি জিনিসে ঠাসা, ফেলুদা মন্তব্য করল।
দীননাথবাবু হেসে বললেন, হ্যাঁ, একটা ছোটখাটা কিউরিও শপ বলতে পারেন। যা নোংরা, ঘেঁটে দেখার প্রবৃত্তি হয়নি আমার।
ফেলুদা উপরের তাকটা বাইরে বার করে ভিতরের জিনিসগুলো দেখছিল। পাথরের মালা, তামা ও পিতলের কাজ করা চাকতি, রোল করা তেলচিটে তাখো, কয়েকটা অচেনা ওষুধের খালি বোতল, দুটো মোমবাতি, একটা ছোট ঘণ্টা, একটা কীসের জানি হাড়, ছোট ছোট দু-তিনটে বাটি, কিছু শিকড় বাকল জাতীয় জিনিস, একটা শুকনো ফুল–সব মিলিয়ে সত্যিই একটা কিউরিওর দোকান।
ফেলুদা বলল, এ বাক্স আপনার জ্যাঠামশাইয়ের কি?
ওঁর সঙ্গেই তো এসেছিল, কাজেই…
কাঠমুণ্ডু থেকে কবে আসেন। আপনার জ্যাঠামশাই?
টোয়েন্টিথ্রিতে। সে বছরই মারা যান। আমার বয়স তখন সাত।
ভেরি ইন্টারেস্টিং বলে চায়ে চুমুক দিয়ে ফেলুদা উঠে পড়ে বলল, আপনি যখন বলছেন তখন আমরা সিমলা যাওয়াই স্থির করলাম। কাল হবে না, কারণ আমাদের দুজনেরই গরম কাপড় লক্তি থেকে আনতে হবে। পরশু কলকা মেলে বেরোনো যেতে পারে। তবে আপনি ধমীজীকে কাল টেলিগ্ৰাম করতে ভুলবেন না।
প্রায় সাড়ে আটটার সময় দীননাথবাবুর বাড়ি থেকে ফিরে এসে বৈঠকখানায় ঢুকেই দেখি জটায়ু বসে আছেন, তাঁর হাতে একটা ব্ৰাউন কাগজের প্যাকেট। আমাদের দেখেই একগাল হেসে বললেন, বায়স্কোপ দেখে ফিরলেন বুঝি?
০৪. জটায়ু হল লালমোহন গাঙ্গুলীর ছদ্মনাম
জটায়ু হল স্বনামধন্য রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনী লেখক লালমোহন গাঙ্গুলীর ছদ্মনাম। সোনার কেল্লা অভিযানে এর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। এক ধরনের লোক থাকে যারা চুপচাপ বসে থাকলেও তাদের দেখে হাসি পায়। লালমোহনবাবু হলেন সেই ধরনের লোক। হাইটে ফেলুদার কাঁধের কাছে, পায়ে পাঁচ নম্বরের জুতো, শরীরটা চিমড়ে হওয়া সত্ত্বেও মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক ভাবে ডান হাতটা কনুইয়ের কাছে ভাঁজ করে বা হাত দিয়ে কোটের আস্তিনের ভেতর বাইসেপ টিপে দেখেন, আবার পরমুহূর্তেই পাশের ঘর থেকে আচমকা হাঁচির শব্দ শুনে আঁতকে ওঠেন।
আপনার আর শ্ৰীমান তপোশের জন্য আমার লেটেস্ট বইটা নিয়ে এলুম।
ভদ্রলোক প্যাকেটটা ফেলুদার দিকে এগিয়ে দিলেন। সোনার কেল্লার ঘটনার পর থেকে ভদ্রলোক মাসে অন্তত তিনবার করে আমাদের বাড়িতে আসেন।
এটা কোন দেশ নিয়ে লেখা? ফেলুদা প্যাকেট খুলতে খুলতে প্রশ্ন করল।
এটা প্ৰায় গোটা ওয়ার্লডটা কভার করিচি। ফ্রম সুমাত্রা টু সুমেরু।
এবারে আর কোনও তথ্যের গণ্ডগোল নেই তো? ফেলুদা বইটা উলটেপালটে দেখে আমার হাতে দিয়ে দিল। এর আগে ওঁর সাহারায় শিহরণ বইতে উটের জল খাওয়া নিয়ে একটা আজগুবি কথা লিখে বসেছিলেন লালমোহনবাবু, পরে ফেলুদা সেটা শুধরে দিয়েছিল।
ভদ্রলোক বললেন, নো স্যার! আমাদের গড়পার রোদে বদন বাঁড়ুজ্যের বাড়িতে ফুল সেট এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিয়া রয়েছে। প্রত্যেকটি ফ্যাক্ট দেখে মিলিয়ে নিয়েছি।
ফেলুদার ব্রিটানিয়া না দেখে ব্রিটানিকা দেখলে আরও নিশ্চিন্ত হতাম-কথাটায় কান না দিয়ে লালমোহনবাবু বলে চললেন, একটা ক্লাইমেক্স আছে পড়ে দেখবেন–আমার হিরো প্রখর রুদ্রের সঙ্গে জলহস্তীর ফাইট।
জলহস্তী?
কীরকম থ্রিলিং ব্যাপার পড়ে দেখবেন।
কোথায় হচ্ছে ফাইটটা?
কেন, নর্থ পোলে! জলহস্তী বলচি না?
নৰ্থ পোলে জলহস্তী?
সে কী মশাই–ছবি দেখেননি? খ্যাংরা কাঠির মতো লম্বা লম্বা খোঁচা খোঁচা গোঁফ, দুটো করে বাইরে বেরিয়ে আসা মুলোর মতো দাঁত, থ্যাপ থ্যাপ করে বরফের ওপর দিয়ে–
সে তো সিন্ধুঘোটক। যাকে ইংরেজিতে বলে ওয়লরাস। জলহস্তী তো হিপোপটেমাস–আফ্রিকার জন্তু।
জটায়ুর জিভা লজ্জায় লাল হয়ে দু ইঞ্চি বেরিয়ে এল।
এঃ–ছ্যা ছ্যা ছ্যা ছ্যা। ব্যাড মিসটেক। ঘোড়া আর হাতিতে গণ্ডগোল হয়ে গেছে। জল আর সিন্ধু তো প্রায় একই জিনিস হল কিনা! ইংরিজিটা কারেক্ট জানা ছিল, জানেন। এবার থেকে গপ্পগুলো ছাপার আগে একবার আপনাকে দেখিয়ে নেব।