ফেলুদা হ্যাঁ বলে বেশ মেজাজের সঙ্গে পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে একটু পিছন দিকে হেলে আরাম করে বসল। আমার কেন জানি ভদ্রলোকের মুখটা চেনা চেনা লাগছিল, যদিও কারণটা বুঝতে পারছিলাম না। শেষটায় ভাবলাম একটা চান্স নিয়ে দেখতে ক্ষতি কী? জিজ্ঞেস করলাম–
আপনি কি কোনও ফিল্মে অ্যাকটিং করেছেন?
ভদ্রলোক একটা গলা খাকরানি দিয়ে বললেন, হ্যাঁ। অশরীরী। থ্রিলার। ভিলেনের পার্ট করেছি। অবিশ্যি ছবিটা এখনও রিলিজ হয়নি।
কী নাম বলুন তো আপনার?
আসল নাম প্রবীর লাহিড়ী। ফিল্মের নাম অমরকুমার।
হ্যাঁ হ্যাঁ–অমরকুমার-মনে পড়েছে।
কোনও একটা ফিল্মের পত্রিকায় ভদ্রলোকের ছবি দেখেছি। এত পাতলা গলার স্বরে কীরকম ভিলেন হবে কে জানে!
অ্যাকটিং কি আপনার পেশা?
এবার প্রশ্নটা ফেলুদার। ভদ্রলোক চেয়ারে না বসে কেন যে দাঁড়িয়ে আছেন জানি না।
কাকার প্লাস্টিকের কারখানায় বসতে হয়। কিন্তু আমার আসল ঝোঁক অ্যাকটিং-এর দিকে।
কাকা কী বলেন?
কাকার…উৎসাহ নেই।
কেন?
কাকা ওইরকমই।
অমরকুমারের মুখ গোমড়া। বুঝলাম কাকার সঙ্গে ফিল্মের ব্যাপারে কথা কাটাকাটি হয়েছে।
একটা কথা আমার জিজ্ঞেস করার আছে। লোকটার মধ্যে একটা রাগী রাগী ভাব আছে বলেই ফেলুদা বোধহয় এত নরম করে কথা বলছে।
আমরকুমার বললেন, আপনার কথার জবাব দিতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু কাকার কনস্ট্যান্ট খোঁচানোটা…
আপনার কাকা আপনাকে একটা এয়ার ইন্ডিয়ার ব্যাগ দিয়েছিলেন কি?
হ্যাঁ! কিন্তু সেটা দেখছি কে যেন ঝেড়ে দিয়েছে। আমাদের একটা নতুন চাকর–
ফেলুদা হেসে হাত তুলে প্রবীরবাবুকে থামিয়ে দিয়ে বলল, না, কোনও নতুন চাকরি আপনার ব্যাগ ঝেড়ে দেয়নি। ওটা রয়েছে আমার কাছে।
আপনার কাছে? প্রবীরবাবু অবাক।
হ্যাঁ। আপনার কাকাই হঠাৎ ডিসাইড করেন ওটা যার ব্যাগ তাকে ফেরত দেওয়া উচিত সে কাজের ভারটা আমাকে দিয়েছেন। এখন কথা হচ্ছে, ওর ভেতর থেকে আপনি কোনও জিনিস বার করে নিয়েছেন কি?
ন্যাচারেলি। এই তো—
প্রবীরবাবু পকেট থেকে একটা ডট পেন বার করে দেখালেন। তারপর বললেন, ব্লেড আর শেভিং ক্রিামটাও ইউজ করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সে তে চান্সই হল না।
কিন্তু বুঝতেই পারছেন প্রবীরবাবু, বাক্সটা ফেরত দিতে হলে সব জিনিসপত্তর সমেত ফেরত দিতে হবে তো–একেবারে ইনট্যাক্ট!
ন্যাচারেলি!
প্রবীরবাবু ডট পেনাটা ফেলুদার দিকে এগিয়ে দিলেন। ফেলুদা ধন্যবাদ দিয়ে সেটা পকেটে পুরে নিল। কিন্তু কাকার উপরে প্রবীরবাবুর রাগটা এখনও পড়েনি। বললেন, জিনিসটা যখন দিয়েই দিয়েছিলেন তখন সেটা নেবার সময় একবার–
প্রবীরবাবুর কথা শেষ হল না। দীননাথের গাড়ির গভীর হর্নের আওয়াজ পাওয়া মাত্র ফিল্মের ভিলেন অমরকুমার সুড়সুড়ি করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
এহে—আপনারা এসে বসে আছেন?
দীননাথবাবু ঘরে ঢুকে অত্যন্ত লজ্জিত ভাবে ঘাড় বেঁকিয়ে হাত দুটো নমস্কারের ভঙ্গিতে জড়ো করে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। আমরা দুজনেই উঠে দাঁড়িয়েছিলাম, ভদ্রলোক ব্যস্তভাবে বললেন, বসুন বসুন–প্লিজ।…আপনাদের অসময়ে চা খেতে আপত্তি নেই নিশ্চয়ই। ওরে-কে আছিস–
চাকরকে চায়ের আড়ার দিয়ে ভদ্রলোক আমাদের পাশের সোফায় বসে বললেন, বলুন, কী খবর।
ফেলুদা বলল, আপনার ব্যাগ বদল হয়েছে আপেলওয়ালার সঙ্গে–নাম জি সি ধমীজা। দীননাথবাবু চোখ গোল গোল করে বললেন, আপনি এর মধ্যে এই একদিনেই নামটা বের করে ফেললেন? এ কি ম্যাজিক নাকি মশাই!
সিমলায়, ঠিকানাও জোগাড় হয়েছে। গ্র্যান্ড হোটেলে এসে ছিলেন, তিনদিন থাকার কথা ছিল, দুদিন থেকে চলে গেছেন।
চলে গেছেন?
দীননাথবাবু যেন একটু হতাশভাবেই প্রশ্নটা করলেন। আজ্ঞে হ্যাঁ। হোটেল থেকে চলে গেছেন, তবে সিমলা গেছেন কি না বলতে পারি না। সেটা অবিশ্যি ওঁর সিমলার ঠিকানায় একটা টেলিগ্রাম করলেই জানতে পারবেন।
দীননাথবাবু কিছুক্ষণ চিন্তিতভাবে চুপ করে থেকে বললেন, আপনি এক কাজ করুন। টেলিগ্ৰাম অবিশ্যি আমি আজই করছি, কিন্তু ধরুন জানতে পারলাম তিনি সিমলা ফিরেছেন এবং তাঁর কাছে আমার বাক্সটা রয়েছে—তা হলেই তো আর কাজটা ফুরিয়ে যাচ্ছে না। তাঁর ব্যাগটা তো তাঁকে ফেরত দিতে হবে।
হ্যাঁ—হাঁ–তা তো বটেই। তা ছাড়া ওই ভ্ৰমণকাহিনীটা সম্পর্কে আমার একটা কৌতূহলও রয়েছে, কাজেই আপনার বাক্সটাও ফেরত আনতে হবে।
ভেরি গুড। আমার প্রস্তাব হচ্ছে–আমি আপনাকে সব খরচ দিচ্ছি, আপনি চট করে সিমলাটা ঘুরে আসুন। আমি বলি কী, আপনার এই ভাইটিকেও নিয়ে যান। সিমলায় এ সময় বরফ–জানেন তো? হাতের কাছে বরফ দেখেছ কখনও খোকা?
অন্য সময়ে হলে খোকা বলতে আমার রাগই হত, কিন্তু সিমলায় যাবার চান্স আছে বুঝতে পেরে ওটা আর গায়েই করলাম না। আমার বুকের ভেতর ঘোড়দৌড় শুরু হয়ে গিয়েছে।
ফেলুদার পরের কথাটা শুনে কিন্তু আমার বেশ বিরক্তই লাগল। ও বলল, একটা জিনিস ভেবে দেখুন মিস্টার লাহিড়ী–আপনি কিন্তু ইচ্ছে করলে এখন যে-কোনও লোককেই সিমলা পাঠিয়ে দিতে পারেন। ওঁর বাক্সটা ফেরত দিয়ে আপনারটা নিয়ে আসা–এ ছাড়া তো কোনও কাজ নেই! কাজেই–
না না না, লাহিড়ী মশাই বেশ জোরের সঙ্গে প্রতিবাদ করলেন। আপনার মতো রিলায়েবল লোক আর পাচ্ছি কোথায়? আর শুরুটা যখন আপনাকে দিয়ে হয়েছে, শেষটাও আপনিই করুন।