সটান রিসেপশন কাউন্টারে গিয়ে ফেলুদা জিজ্ঞেস করল, আপনার এখানে ৬ই মার্চ সকালে সিমলা থেকে কোনও গেস্ট এসেছিলেন কি–যার নামের প্রথম অক্ষর G?
প্রশ্নটা শুনে আমার এই প্রথম খেয়াল হল যে বৃজমোহন বা নরেশ পাকড়াশী কারুরই নামের প্রথম অক্ষর G নয়। কাজেই এখন বাকি রয়েছেন শুধু আপেলওয়ালা।
রিসেপশনের লোক খাতা দেখে বলল, দুজন সাহেবের নাম পাচ্ছি G দিয়ে—জেরাল্ড প্রাট্লি এবং জি আর হোমস। দুজনেই ভারতবর্ষের বাইরে থেকে এসেছিলেন।
থ্যাঙ্ক ইউ, বলে ফেলুদা বিদায় নিল।
বাইরে বেরিয়ে এসে একটা ট্যাক্সি নেওয়া হল। পার্ক হোটেল চলিয়ে বলে ড্রাইভারকে একটা হুকুম দিয়ে একটা চারমিনার ধরিয়ে ফেলুদা বলল, ম্যাপের উপর লাল দাগগুলো ভাল করে লক্ষ করলে –দেখতিস যে সেগুলো সব একেকটা হোটেলের জায়গায় দেওয়া হয়েছে। সুতরাং কলকাতায় এসে ভদ্রলোকের হাটেলে ওঠাই স্বাভাবিক। ভাল হোটেল বলতে এখন গ্র্যান্ড, হিন্দুস্থান ইনটারন্যাশনাল, পার্ক, গ্রেট ইস্টার্ন আর রিটজ কানটিনেন্টাল। দাগও ছিল ঠিক এই পাঁচ জায়গায়। আমাদের রাস্তায় প্রথম পড়ছে পার্ক হাটেল, কাজেই সেটা হবে। আমাদের গন্তব্যস্থল।
পার্ক হোটেলে ছ তারিখে নামের প্রথম অক্ষর G দিয়ে কেউ আসেনি, কিন্তু গ্র্যান্ড হাটেলে গিয়ে ভাল খবর পাওয়া গেল। একজন বাঙালি রিসেপশনিস্টের সঙ্গে দেখলাম ফেলুদার চেনাও রয়েছে। এই ভদ্রলোক-নাম দাশগুপ্ত-খাতা খুলে দেখিয়ে দিলেন যে ৬ই মার্চ সকালে পাঁচজন এ হোটেলে এসে উঠেছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজনই ভারতীয়, আর তিনি সিমলা থেকে এসেছিলেন, আর তাঁর নাম জি সি ধমীজা।
এখনও আছেন কি ভদ্রলোক? ফেলুদা প্রশ্ন করল।
নো স্যার। গতকাল সকালে তিনি চেক-আউট করে গেছেন।
আমার মনে একটা আশার আলো জ্বলেছিল, সেটা আবার দপ করে নিভে গেল।
ফেলুদার ভুরু কুঁচকে গেছে। কিন্তু সে তবু প্রশ্ন করতে ছাড়ল না।
কত নম্বর ঘরে ছিলেন?
দুশো ষোলো।
সে ঘর কি এখন খালি?
অজ্ঞে হ্যাঁ। আজি সন্ধ্যায়। একজন গেস্ট আসছেন, তবে এখন খালি।
সেই ঘরের বেয়ারার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?
সার্টেনলি। আমি সঙ্গে লোক দিয়ে দিচ্ছি, ও-ই আপনাকে রুম-বিয়ের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবে।
লিফট দিয়ে দোতলায় উঠে লম্বা বারান্দা দিয়ে বেশ খানিকটা হেঁটে গিয়ে তারপর দুশো ষোলো নম্বর ঘর। রুম-বয়ের দেখা পেয়ে তাকে নিয়ে ঘরে ঢুকল ফেলুদা। তারপর এদিক ওদিক দু-একবার পায়চারি করে, প্রশ্ন করল–
গতকাল সকালে যে ভদ্রলোক চলে গেছেন তাকে মনে পড়ছে?
হাঁ সাহাব।
ভাল করে মনে করে দেখ তো।–তার সঙ্গে জিনিসপত্তর কী কী ছিল।
একঠো বড় সুটকেশ থা, কালা, আউর এক ছোটা ব্যাগ।
নীল রঙের ব্যাগ কি?
হাঁ সাহাব। হাম্ যব্ ফিলাস্কমে পানি লেকর্ কামরেমে আয়া, তব্ সাহাবকে দেখা উয়ো ছোট ব্যাগ খোলকর্ সব চিজ বাহার নিকালকে বিস্তারে-পর রাখখা। মেরা মালুম হুয়া সাহাব কুছ্ ঢুঁড় রাহা।
ভেরি গুড। বাবুর সঙ্গে আপেল ছিল কি না মনে আছে?
হাঁ বাবু! তিন আপিল থা; বাহার নিকালকে পিলেটিমে রাখখা।
এর পরে বাবুর চেহারা কীরকম ছিল জিজ্ঞেস করাতে বয় যা বলল, সেরকম চেহারার লোক কলকাতায় অন্তত লাখখানেক আছে।
যাই হাক-গ্র্যান্ড হাটেলে এসে মস্ত কাজ হয়েছে। দীননাথবাবুর বাক্স যার সঙ্গে বদল হয়েছে তার নাম ঠিকানা দুটোই পাওয়া গেছে। ঠিকানাটা মিস্টার দাশগুপ্ত একটা কাগজে লিখে রেখেছিলেন। যাবার সময় সেটা ফেলুদার হাতে দিয়ে দিলেন। ফেলুদার সঙ্গে সঙ্গে আমিও পড়ে দেখলাম তাতে লেখা রয়েছে–
G. C. Dhameeja,
‘The Nook,’
Wild Flower Halt,
Simla.
০৩. দীননাথবাবুর ভাইপো
কাকা একটু বেরিয়েছেন। সাতটা নাগাত ফিরবেন।
ইনিই তা হলে দীননাথবাবুর ভাইপো
গ্র্যান্ড হোটেল থেকে বেরিয়ে নিউ এম্পায়ারের সামনের দোকান থেকে মিঠে পান। কিনে আমরা সোজা চলে এসেছি। রাডন স্ট্রিটে দীননাথবাবুর বাড়িতে। কারণটা হল আজকের ঘটনার রিপোর্ট দেওয়া। বাড়ির গেটের ভিতর দিয়ে ঢুকে বাঁদিকে পর পর চারটি গ্যারাজ, তার তিনটে খালি, আর একটাতে রয়েছে আরেকটা অদ্ভুত ধরনের পুরনো গাড়ি। ফেলুদা বলল ওটা নাকি ইটালিয়ান গাড়ি, নাম লাগন্ডা।
দারোয়ানের হাতে কার্ড দেবার এক মিনিটের মধ্যেই এই ইয়াং ভদ্রলোকটি বেরিয়ে এলেন। বয়স মনে হয় ত্ৰিশের নীচে, মাঝারি হাইট, দীননাথবাবুর মতোই ফরসা রং, উসকোথুসকো চুলের পিছন দিক বেশ লম্বা, আর কানের দুপাশে লম্বা ঝুলপি, যে রকম ঝুলপি আজকাল অনেকেই রাখছে। ভদ্রলোক একদৃষ্টি ফেলুদার দিকে চেয়ে আছেন।
ফেলুদা বলল, আমরা একটু বসতে পারি কি? একটু দরকার ছিল ওঁর সঙ্গে।
আসুন…
ভদ্রলোক আমাদের ভিতরে বৈঠকখানায় নিয়ে গিয়ে বসালেন। দেয়ালে আর মেঝেতে বাঘ ভালুকের ছালের ছড়াছড়ি, সামনের দরজার উপরে একটা প্রকাণ্ড বাইসনের মাথা। দীননাথবাবুর জ্যাঠামশাইও কি তা হলে শিকারি ছিলেন? হয়তো শিকারের সূত্রেই শম্ভুচরণের সঙ্গে এত বন্ধুত্ব।
কাকা বিকেলে একটু বেড়াতে বেরোন! এইবার আসবেন।
ভদ্রলোকের গলার স্বর একটু বেশি রকম পাতলা! একেই কি দীননাথবাবু ধমীজার বাক্সটা দিয়েছিলেন?
আপনিই কি ফেলুমিত্তির—যিনি সোনার কেল্লার রহস্য সলভ্ করেছিলেন? ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন।