হ্যাঁ। শম্ভুচরণ বাসের লেখা একটা ভ্রমণকাহিনী। ট্রেনে উনি লেখাটা পড়ছিলেন। সেটা ওই বাক্সতেই ছিল।
শুধু ফুল নয়–হি সীমস টু বি এ লায়ার টু। খবরের কাগজ আর বাংলা মাসিক পত্রিকা ছাড়া আর কিসু্য পড়েনি লোকটা। আমার সিট যদিও ছিল ওর ওপরের ব্যাঙ্কে, দিনের বেলাটা আমি নীচেই বসেছিলাম, ওর সিটেরই একটা পাশে। উনি কী পড়ছিলেন না-পড়ছিলেন সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট খেয়াল আছে।
ফেলুদা চুপ। ভদ্রলোক একটু দম নিয়ে বললেন, আপনি গোয়েন্দা হয়ে কী বুঝছেন জানি না; আপনার মুখে সামান্য যা শুনলাম তাতে ব্যাপারটা বেশ সাসপিশাস্ বলে মনে হচ্ছে। এনিওয়ে আপনি বুনো হাঁস ধাওয়া করতে চান করুন, কিন্তু আমার কাছ থেকে কোনও হেলপ পাবেন না। আপনাকে তো টেলিফোনেই বললুম, ওরকম এয়ার ইন্ডিয়ার ব্যাগ আমার বাড়িতে গোটা তিনেক পড়ে আছে কিন্তু এবারে সঙ্গে সে ব্যাগ ছিল না–সো আই কান্ট হেলপ ইউ।
যাত্রী চারজনের মধ্যে একজনের সঙ্গে বোধহয় আপনার চেনা বেরিয়ে গোসল–তাই না?
কে–বৃজমোহন? হ্যাঁ। তেজারতির কারবার আছে। আমার সঙ্গে এক কালে কিছু ডিলিংস হয়েছে।
তেজারাতির কারবার মানে সুদে টাকা খাটানোর ব্যবসা, সেটা ফেলুদা আমাকে পরে বলে দিয়েছিল।
ফেলুদা বলল, এই বৃজমোহনের কাছে কি ওইরকম একটা ব্যাগ থেকে থাকতে পারে?
সেটা আমি কী করে জানব, হ্যাঁ?
এর পর থেকে ভদ্রলোক ফেলুদাকে আপনি বলা বন্ধ করে তুমিতে চলে গেলেন। ফেলুদা বলল, এই ভদ্রলোকের হদিসটা দিতে পারেন?
ডিরেক্টরি দেখে নিয়ো, মিস্টার পাকড়াশী বললেন, এস এম কেন্দিয়া এন্ড কোম্পানি। এস এম হল বৃজমোহনের বাবা। ধরমতলায়—থুড়ি, লেনিন সরণিতে আপিস। তবে তুমি যে বলছি একজনের সঙ্গে আলাপ ছিল, তা নয়; আসলে তিনজনের মধ্যে দুজনকে চিনতুম আমি।
ফেলুদা যেন একটু অবাক হয়েই প্রশ্ন করল, অন্যজনটি কে?
দীননাথ লাহিড়ী। এককালে রেসের মাঠে দেখতুম ওকে। আলাপ হয়েছিল একবার। আগে খুব লায়েক ছিল। ইদানীং নাকি সভ্যভব্য হয়েছে। দিল্লিতে নাকি এক গুরু বাগিয়েছে। সত্যি কি মিথ্যে জানি না।
আর অন্য যে যাত্রীটি ছিলেন?
বুঝতে পারলাম ফেলুদা যতদূর পারে ইনফরমেশন সংগ্রহ করে নিচ্ছে ভদ্রলোকের কাছে। এটা কি জেরা হচ্ছে? ভদ্রলোক পাইপ কামড়ানা অবস্থাতেই তাঁর বত্ৰিশ পাটি দাঁত খিঁচিয়ে প্রশ্ন করলেন।
আজ্ঞে না, ফেলুদা বলল, আপনি বাড়িতে বসে এক এক দাবা খেলেন, আপনার মাথা পরিষ্কার, আপনার স্মরণশক্তি ভাল–এই সব ভেবেই আপনাকে জিজ্ঞেস করছি।
পাকড়াশী মশাই বোধহয় একটু নরম হলেন। গলাটা একবার খাকরে নিয়ে বললেন, চেস্টা আমার একটা অদম্য নেশা! খেলার যে সঙ্গীটি ছিলেন তিনি গত হয়েছেন, তাই এখন একই খেলি।
রোজ?
ডেইলি। তার আরেকটা কারণ আমার ইনসমনিয়া। রাত তিনটে পর্যন্ত চলবে এই খেলা।
ঘুমের বড়ি খান না?
খাই-তবে বিশেষ কাজ দেয় না। তাতে যে শরীর কিছু খারাপ হচ্ছে তা নয়। তিনটেয় ঘুমোই, আটটায় উঠি। এ বয়সে পাঁচ ঘণ্টা ইজ এনাফ!
টাইপিংটাও কি আপনার একটা নেশা? ফেলুদা তার এক-পেশে হাসি হেসে বলল।
না। ওটা মাঝে মাঝে করি। সেক্রেটারি রেখে দেখেছি-এক ধার থেকে সব ফাঁকিবাজ। যাই হাক-আপনি অন্য যাত্রীটির কথা জিজ্ঞেস করছিলেন না?–শার্প চেহারা, মাথায় টাক, বাঙালি নয়, ইংরিজি উচ্চারণ ভাল, আমায় একটা আপেল অফার করেছিলেন, খাইনি। আর কিছু? আমার বয়স তিল্পান্ন, আমার কুকুরের বয়স সাড়ে তিন। ওটা জাতে বক্সার হাউন্ড। বাইরের, লোক আমার ঘরে এসে আধঘণ্টার বেশি থাকে সেটা ও পছন্দ করে না। কাজেই—
ইন্টারেস্টিং লোক, ফেলুদা মন্তব্য করল।
আমরা ল্যানসডাউন রোডে বেরিয়ে এসে দক্ষিণে না গিয়ে উত্তর দিকে কেন চলেছি, আর পাশ দিয়ে দুটো খালি ট্যাক্সি বেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ফেলুদা কেন সেগুলোকে ডাকল না, তা আমি জানি না। আমার একটা কথা মনে হচ্ছিল, সেটা ফেলুদাকে না বলে পারলাম না–
আচ্ছা, দীননাথবাবু যে বলেছিলেন পাকড়াশীর বয়স ষাটের উপর, অথচ পাকড়াশী নিজে বললেন তিপ্পিান্ন। আর ভদ্রলোককে দেখেও পঞ্চাশের খুব বেশি বলে মনে হয় না! এটা কীরকম হল?
ফেলুদা বলল, তাতে শুধু এইটেই প্রমাণ হয় যে, দীননাথবাবুর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা খুব তীক্ষ্ণ নয়।
আরও মিনিট দুয়েক হাঁটতেই আমরা লোয়ার সারকুলার রোডে পড়লাম। ফেলুদা বা দিকে ঘুরল। আমি বললাম, সেই ডাকাতির ব্যাপারে তদন্ত করতে যাচ্ছ বুঝি? তিনদিন আগেই খবরের কাগজে বেরিয়েছে যে, লোয়ার সারকুলার রোডে হিন্দুস্থান ইন্টারন্যাশনাল হাটেলের কাছেই একটা গয়নার দোকানে তিনজন মুখোশ-পরা রিভলভারধারী লোক ঢুকে বেশ কিছু দামি পাথরটাথর নিয়ে বেয়াড়াভাবে দুমদাম রিভলভার ছুঁড়তে ছুড়তে একটা কালো অ্যাম্বাসাড়ার করে পালিয়েছে। ফেলুদা খবরটা পড়ে বলেছিল, এই ধরনের একটা বেপরোয়া ক্রাইমের তদন্ত করতে পারলে মন্দ হত না। কিন্তু দুঃখের বিষয় কেসটা ফেলুদার কাছে আসেনি। তাই আমি ভাবলাম, ও হয়তো নিজেই একটু খোঁজখবর করতে যাচ্ছে।
ফেলুদা কিন্তু আমার প্রশ্নটায় কানই দিল না। ওর ভাব দেখে মনে হল, ও ফেন ওয়াকিং এক্সারসাইজ করতে বেরিয়েছে, তাই হাঁটা ছাড়া কোনওদিকে মন নেই। কিন্তু মিনিটখানেক হাঁটার পরে ও হঠাৎ রাস্তা থেকে বাঁয়ে ঘুরে সোজা গিয়ে ঢুকল হিন্দুস্থান ইন্টারন্যাশনাল হাটেলের গেটের ভিতর, আর আমিও ঢুকলাম তার পেছন পেছন।