হুঁ… ফেলুদা কিছুক্ষণ চুপ। তারপর কথাগুলো খুব স্পষ্ট উচ্চারণ করে ধীরে ধীরে বলল, আচ্ছা! ধরুন, আজ যদি হঠাৎ জানা যায় যে, তিব্বত ভ্ৰমণ সম্পর্কে তার একটা অপ্রকাশিত বড় লেখা রয়েছে, ইংরিজিতে, তা হলে সেটা দামি জিনিস হবে না কি?
ওরেব্বাবা! সিধুজ্যাঠার চকচকে টাকা উত্তেজনায় নেচে উঠল। কী বলছ ফেলু–টেরাই পড়ে লন্ডন টাইমস কী উচ্ছাস করেছিল সে তো মনে আছে আমার! আর শুধু কাহিনী নয়, শদ্ভুচরণের ইংরেজি ছিল যেমন স্বচ্ছ, তেমনি রংদার। একেবারে স্ফটিকের মতো। ম্যানুস্ক্রিপ্ট আছে নকি?
হয়তো আছে।
যদি তোমার হাতে আসে, আমাকে একবারটি দেখিয়ো, আর যদি অকশনে বিক্রি-টিক্রি হচ্ছে বলে খবর পাও, তা হলেও জানিয়ো। আমি হাজার পাঁচেক পৰ্যন্ত বিড করতে রাজি আছি।…
সিধুজ্যাঠার বাড়িতে গরম কোকো খেয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসে ফেলুদাকে বললাম, মিস্টার লাহিড়ীর বাক্সে যে একটা এত দামি জিনিস রয়েছে সেটা তো উনি জানেনই না। ওকে জানাবে না?
ফেলুদা বলল, অত তাড়া কীসের? আগে দেখি না কোথাকার জল কোথায় গড়ায়। আর কাজের ভারটা তো আমি এমনিতেই নিয়েছি, কেবল উৎসাহটা একটু বেশি পাচ্ছি, এই যা৷
নরেশচন্দ্ৰ পাকড়াশীর বাড়িটা হল ল্যানসডাউন রোডে। দেখলেই বোঝা যায় অন্তত চল্লিশ বছরের পুরনো বাড়ি। ফেলুদা আমাকে শিখিয়ে দিয়েছে একটা বাড়ির কোন কোন জিনিস থেকে তার বয়সটা আন্দাজ করা যায়। যেমন, পঞ্চাশ বছর আগে একরকম জানালী ছিল যেটা চল্লিশ৷ বছর আগের বাড়িতে আর দেখা যায় না। তা ছাড়া বারান্দার রেলিং-এর প্যাটার্ন, ছাতের পাঁচিল, গেটের নকশা, গাড়িবারান্দার থাম—এই সব থেকেও বাড়ির বয়স আন্দাজ করা যায়। এ বাড়িটা নির্ঘাত উনিশশো কুড়ি থেকে ত্ৰিশের মধ্যে তৈরি।
ট্যাক্সি থেকে নেমে বাড়ির সামনে প্রথমেই চোখে পড়ল গেটের উপর লটকানো কাঠের ফলক, কুকুর হইতে সাবধান!” ফেলুদা বলল, কুকুরের মালিক হইতে সাবধান কথাটাও লেখা উচিত ছিল। গেট দিয়ে ঢুকে এগিয়ে গিয়ে গাড়িবারান্দার নীচে পৌঁছতেই দারোয়নের দেখা পেলাম, আর ফেলুদা তার হাতে দিয়ে দিল তার ভিজিটিং কার্ড, যাতে লেখা আছে Pradosh C. Mitter, Private investigator, মিনিট খানেকের মধ্যেই দারোয়ান ফিরে এসে श्व्लाळ, भक्लिक আমাদের ভিতরে ডাকছেন।
মার্বেল পাথরে বাঁধানে ল্যান্ডিং পেরিয়ে প্রায় দশ ফুট উঁচু দরজার পর্দ ফাঁক করে আমরা যে ঘরটায় ঢুকলাম সেটা বৈঠকখানা। প্রকাণ্ড ঘরের তিনদিকে উঁচু উঁচু বইয়ের আলমারিতে ঠাসা বই। এ ছাড়া ফার্নিচার, কাৰ্পেট, দেয়ালে ছবি, আর মাথার উপরে ঝাড় লণ্ঠন—এসবও আছে। কিন্তু তার সঙ্গে রয়েছে একটা অগোছালো অপরিষ্কার ভাব। এ বাড়িতে ঝাড়পোঁছ জিনিসটার যে বিশেষ বালাই নেই সেটা সহজেই বোঝা যায়।
মিস্টার পাকড়শীকে পেলাম বৈঠকখানার পিছন দিকের ঘরটায়। দেখে বুঝলাম এটা তাঁর আপিস—বা যাকে বলে স্টাডি। টাইপ করার শব্দ আগেই পেয়েছিলাম, ঢুকে দেখলাম ভদ্রলোক একটা সবুজ রেক্সিনে ঢাকা প্ৰকাণ্ড টেবিলের পিছনে একটা মান্ধাতার আমলের প্ৰকাণ্ড টাইপরাইটার সামনে নিয়ে বসে আছেন। টেবিলটা রয়েছে। ঘরের ডান দিকে। বাঁ দিকে রয়েছে একটা আলাদা বসবার জায়গা। তিনটে কোঁচ, আর তার সামনে একটা নিচু গোল টেবিল। এই টেবিলের উপর আবার রয়েছে ঘুটি সাজানো একটা দাবার বোর্ড, আর তার পাশেই একটা দাবার বই। সব শেষে যেটা চোখে পড়ল সেটা হল টেবিলের পিছন দিকে কার্পেটের উপর কুণ্ডলী পাকিয়ে শোয়া একটা জাঁদরেল কুকুর।
ভদ্রলোকের নিজের চেহারা দীননাথবাবুর বর্ণনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, কেবল একটা নতুন জিনিস হচ্ছে তার মুখে বাঁকানো পাইপটা।
আমরা ঘরে ঢুকতে টাইপিং বন্ধ করে ভদ্রলোক আমাদের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ফেলুদাকে উদ্দেশ করে বললেন, কোনটি মিস্টার মিত্তির, আপনি না ইনি?
প্রশ্নটা হয়তো মিস্টার পাকড়াশী ঠাট্টা করেই করেছিলেন, কিন্তু ফেলুদা হাসল না। সে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বলল, আজ্ঞে আমি। এটি আমার কাজিন।
পাকড়াশী বললেন, কী করে জানব? গানবাজনা অ্যাকটিং ছবি-আঁকা মায় গুরুগিরিতে পর্যন্ত যদি বালকদের এত ট্যালেন্ট থাকতে পারে, তা হলে গোয়েন্দাগিরিতেই বা থাকবে না কেন? যাকগে, এবারে বলুন—এই সাতে-নেই-পাঁচে-নেই মানুষটিকে এভাবে জ্বালাতে এলেন কেন।
ফেলুদা টেলিফোনে কথা বলে বলেছিল লোকটার মেজাজ রুক্ষ। আমার মনে হল, খিটখিটেমোর জন্য কম্পিটিশন থাকলে ইনি ওয়ার্লড চ্যাম্পিয়ন হতেন।
কে আপনাকে পাঠিয়েছে বললেন? মিস্টার পাকড়াশী প্রশ্ন করলেন।।
মিস্টার লাহিড়ীর কাছ থেকে আপনার নামটা জানি। দিল্লি থেকে আপনার সঙ্গে একই কম্পার্টমেন্টে কলকাতায় এসেছেন তিনদিন আগে।
অ। তারই বাক্স হারিয়েছে বলছে?
আরেকজনের সঙ্গে বদল হয়ে গেছে।
কেয়ারলেস ফুল। তা সেই বাক্স উদ্ধারের জন্য ডিটেকটিভ লাগাতে হল কেন? কী এমন ধনদৌলত ছিল তার মধ্যে শুনি?
বিশেষ কিছু না। একটা পুরনো ম্যানুস্ক্রিপ্ট ছিল। ভ্রমণ-কাহিনী। সেটার আর কপি নেই।
আসল কারণটা বললে পাকড়শী মশাই মোটেই ইমপ্রেসড হতেন না বলেই বাধহয় ফেলুদা লেখার কথাটা বলল!
ম্যানুস্ক্রিপ্ট? পাকড়াশীর যেন কথাটা বিশ্বাস হল না।