৩। একটা সবুজ রঙের বিনাকী টুথব্রাশ
৪। একটা গিলেট সেফটি রেজার
৫। একটা প্যাকেটে তিনটে থিন গিলেট ব্লেণ্ড
৬। একটা প্রায় শেষ-হয়ে-যাওয়া ওলন্ড স্পাইস শেভিং ক্রিম
৭। একটা শেভিং ব্রাশ
৮। একটা নেলক্লিপ—বেশ পুরনো
৯। একটা সেলোফেনের পাতের মধ্যে তিনটে অ্যাসপ্রোর কড়ি
১০। একটা ভাঁজ করা কলকাতা শহরের ম্যাপা-খুললে প্রায় চার ফুট বাই পাঁচ ফুট
১১। একটা কোডাক ফিল্মের কীটের মধ্যে সুপুরি
১২। একটা টেক্কা মাক দেশলাই-আনকোরা নতুন
১৩। একটা ভেনাস মাক লাল-নীল পেনসিল
১৪। একটা ভাঁজ করা রুমাল, তার এককোণে সেলাই করা নকশায় লেখা G
১৫। একটা মোরাদবাদি ছুরি বা পেন নাইফ
১৬। একটা মুখ-মোছা ছোট তোয়ালে
১৭। একটা সেফটি পিন, মর্চে ধরা
১৮। তিনটে জেম ক্লিপ, মর্চে ধরা
১৯। একটা শার্টের বোতাম
২০। একটা ডিটেকটিভ উপন্যাস–এলেরি কুইনের দ্য ডোর বিটউইন
লিস্ট তৈরি হলে পর ফেলুদা উপন্যাসটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে বলল, হুইলার কোম্পানির নাম রয়েছে, কিন্তু যিনি কিনেছেন তাঁর নাম নেই। পাতা ভাঁজ করে পড়ার অভ্যাস আছে ভদ্রলোকের। দুশো ছত্রিশ পাতার বই, শেষ ভাঁজের দাগ রয়েছে দুশো বারো পাতায়! আন্দাজে মনে হয়। ভদ্রলোক বইটা পড়ে শেষ করেছিলেন।
ফেলুদা বই রেখে রুমালের দিকে মন দিল।
ভদ্রলোকের নাম কিংবা পদবির প্রথম অক্ষর হল G। সম্ভবত নাম, কারণ সেটাই আরও স্বাভাবিক!
এবার ফেলুদা কলকাতার ম্যাপটা খুলে টেবিলের উপর পাতল। ম্যাপটার দিকে দেখতে দেখতে ওর দৃষ্টি হঠাৎ এক জায়গায় থেমে গেল। লাল পেনসিলের দাগ… হু…এক, দুই, তিন, চার.পাঁচ জায়গায়…হাঁ..চৌরঙ্গি. চৌরঙ্গি…পার্ক স্ট্রিট…হুঁ…ঠিক আছে। তোপসে একবার টেলিফোন ডিরেক্টরিটা দে তো আমায়।
ম্যাপটা আবার ভাঁজ করে বাক্সে রেখে টেলিফোন ডিরেক্টরির পাতা উলটাতে উলটাতে ফেলুদা বলল, ভাগ্য ভাল যে নামটা পাকড়াশী। তারপর পি অক্ষরে এসে একটা পাতায় একটুক্ষণ চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, সবসুদ্ধ মাত্র ষোলটা পাকড়াশীর বাড়িতে টেলিফোন–তার মধ্যে আবার দুজনে ডাক্তার। সে দুটো অবশ্যই বাদ দেওয়া যেতে পারে।
কোন?
ট্রেনে তার পরিচিত লোকটি পাকড়াশীকে মিস্টার বলে সম্বোধন করেছিল, ডক্টর নয়। ও হ্যাঁ, ঠিক ঠিক! 3 ফেলুদা টেলিফোন তুলে ডায়ালিং শুরু করে দিল। প্রতিবারই নম্বর পাবার পর ও প্রশ্ন করল, মিস্টার পাকড়াশী, কি দিল্লি থেকে ফিরেছেন? পর পর পাঁচবার উত্তর শুনে সরি বলে ফোনটা রেখে দিয়ে আবার অন্য নম্বর ডায়াল করল। ছবারের বার বোধহয় ঠিক লোককে পাওয়া গেল, কারণ কথাবার্তা বেশ কিছুক্ষণ চলল। তারপর ধন্যবাদ বলে ফোন রেখে ফেলুদা বলল, পাওয়া গেছে। এন সি পাকড়াশী; নিজেই কথা বলল। পরশু সকালে দিল্লি থেকে ফিরেছেন কালকা মেলে! সব কিছু মিলে যাচ্ছে, তবে এর কোনও বাক্স বদল হয়নি।
তা হলে আবার বিকেলে অ্যাপিয়েন্টমেন্ট করলে কেন?
অন্য যাত্রীদের সম্পর্কে ইনফরমেশন দিতে পারে তো। লোকটার মেজাজ অত্যন্ত রুক্ষ, যদিও ফেলুমিত্তির তাতে ঘাবড়াবার পাত্র নন। তোপসে, চ বেরিয়ে পড়ি।
সে কী, বিকেলৈ তো অ্যাপয়েন্টমেন্ট।
তার আগে একবার সিধুজ্যাঠার কাছে যাওয়া দরকার।
০২. সিধু জ্যাঠার সঙ্গে
সিধু জ্যাঠার সঙ্গে আসলে আমাদের কোনও আত্মীয়তা নেই। বাবা যখন দেশের বাড়িতে থাকতেন—আমার জন্মের আগে–তখন পাশের বাড়িতে এই সিধুজ্যাঠা থাকতেন। তাই উনি বাবার দাদা আর আমার জ্যাঠা ফেলুদা বলে, সিধুজ্যাঠার মতো এত বিষয়ে এত জ্ঞান, আর এমন আশ্চর্য স্মরণশক্তি, খুব কম লোকের থাকে।
ফেলুদা যে কেন এসেছে সিধুজ্যাঠার কাছে সেটা তার প্রশ্ন শুনে প্রথম জানতে পারলাম—
আচ্ছা, শম্ভুচরণ বোস বলে বছর ষাটেক আগের কোনও ভ্রমণ-কাহিনী লেখকের কথা আপনি জানেন? ইংরিজিতে লিখতেন। তিনি।
সিধু জ্যাঠা চোখ কপালে তুলে বললেন, বিলো কী হে ফেলু-তার লেখা তেরাইয়ের কাহিনী পড়নি?
ঠিক ঠিক, ফেলুদা বলল, এখন মনে পড়ছে। ভদ্রলোকের নামটা চেনাচেন লাগছিল। কিন্তু বইটা হাতে আসেনি কখনও।
Terrors of Terai ছিল বইয়ের নাম। ১৯১৫ সালে লন্ডনের কীগ্যান পল কোম্পানি সে বই ছেপে বার করেছিল। দুর্দান্ত শিকারি ও পর্যটক ছিলেন শম্ভুচরণ। তবে পেশা ছিল ডাক্তারি। কাঠমুণ্ডুতে প্র্যাকটিশ করত। ওখানে তখন রাজ-টাজা হয়নি। রাণারাই ছিল সর্বেসর্বা। রাণী ফ্যামিলির অনেকের কঠিন রোগ সরিয়ে দিয়েছিল শম্ভুচরণ। ওর বইয়ে এক রাণার কথা আছে। বিজয়েন্দ্র শমশের জঙ্গ বাহাদুর। শিকারের খুব শখ, অথচ ঘোর মদ্যপ। এক হাতে বন্দুক, আর এক হাতে মদের বোতল নিয়ে মাচায় বসত। অথচ জানোয়ার সামনে পড়লেই হাত স্টেডি হয়ে যেত। কিন্তু একবার হয়নি। গুলি বাঘের গায়ে লাগেনি। বাঘ লাফিয়ে পড়েছিল মাচার উপর। পাশের মাচায় ছিলেন শম্ভুচরণ। তারই বন্দুকের অব্যৰ্থ গুলি শেষটায় রাণাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। অবিশ্যি রাণীও তাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল একটি মহামূল্য রত্ন উপহার দিয়ে। খ্রিলিং গল্প। ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে এনে পড়ে দেখো! বাজারে চট করে পাবে না।
আচ্ছ উনি কি তিব্বতও গিয়েছিলেন? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
গিয়েছিল বইকী। মারা যায় টোয়েন্টিওয়ানে। আমি তখন সবে বি-এ পরীক্ষা দিয়েছি। কাগজে একটা অবিচুয়ারি বেরিয়েছিল। তাতে লিখেছিল, শম্ভুচরণ রিটায়ার করবার পর তিব্বত যায়। তবে মারা যায় কাঠমুণ্ডুতে।