ফেলুদা একটা চারমিনার ধরাল। দীননাথবাবু সিগারেট খান না। দুটো ধোঁয়ার রিং ছেড়ে ফেলুদা বলল, আপনি চাইছেন—এ বাক্স যার তাকে ফেরত দিয়ে আপনার বাক্সটা আপনার কাছে এনে হাজির করি।–এই তো?
হতাশ হলেন নাকি? ব্যাপারটা বড় নিরামিষ বলে মনে হচ্ছে?
ফেলুদা তার ডান হাতের আঙুলগুলো চুলের মধ্যে দিয়ে চালিয়ে দিয়ে বলল, না। আপনার সেন্টিমেন্ট আমি বুঝতে পেরেছি। যে ধরনের সব কেস আমার কাছে আসে সেগুলোর তুলনায় এই কেসটার যে একটা বৈশিষ্ট্য আছে সেটাও তো অস্বীকার করা যায় না।
দীননাথবাবু যেন অনেকটা আশ্বস্ত হলেন। একটা লম্বা হাঁপা ছেড়ে বললেন, আপনার রাজি হওয়াটা আমার কাছে অনেকখানি।
ফেলুদা বলল, আমার যথাসাধ্য আমি চেষ্টা করব। তবে বুঝতেই পারছেন, এ অবস্থায় গ্যারান্টি দেওয়া সম্ভব নয়! যাই হাক, এবার আপনার কাছ থেকে কিছু তথ্য জেনে নিতে চাই।
বলুন!
ফেলুদা চট করে উঠে পাশেই তার শোবার ঘর থেকে তার বিখ্যাত সবুজ নোটবইটা নিয়ে এল। তারপর হাতে পেনসিল নিয়ে তার প্রশ্ন আরম্ভ করল।
কোন তারিখে রওনা হন দিল্লি থেকে?
পাঁচই মার্চ রবিবার সকাল সাড়ে ছটায় দিল্লি ছেড়েছি। কলকাতায় পৌঁছেছি পরদিন সকাল সাড়ে নটায়।
আজি হল ৯ই। অর্থাৎ গাত তরগু। আর কাল রাত্রে আপনি আমাকে টেলিফোন করেছেন।
ফেলুদা অ্যাটাচি কেসটার ভেতর থেকে একটা হলদে রঙের কোডাক ফিল্মের কৌটো বার করে তার ঢাকনার প্যাঁচটা খুলতেই তার থেকে কয়েকটা সুপুরি বেরিয়ে টেবিলের উপর পড়ল। তার একটা মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে ফেলুদা বলল, আপনার ব্যাগে এমন কিছু ছিল যা থেকে আপনার নাম-ঠিকানা পাওয়া যেতে পারে?
যতদূর মনে পড়ে, কিছুই ছিল না।
হুঁ… এবার আপনার তিনজন সহযাত্রীর মোটামুটি বর্ণনা লিখে নিতে চাই। আপনি যদি একটু হেলপ করেন।
দীননাথবাবু মাথাটাকে চিতিয়ে সিলিং-এর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, পাকড়াশীর বয়স আমার চেয়ে বেশি। ষাট-পয়ষট্টি হবে। গায়ের রং মাঝারি। ব্যাকব্রাশ করা কাঁচাপাকা চুল, চোখে চশমা, কণ্ঠস্বর কর্কশ।
বেশ!
যিনি আপেল দিলেন তাঁর রং ফরসা। রোগা একহারা চেহারা, টিকোলো নাক, চোখে সোনার চশমা, দাঁড়ি গোঁফ কামানো, মাথায় টাক, কেবল ক্যানের পাশে সামান্য কাঁচা চুল। ইংরেজি উচ্চারণ প্রায় সাহেবদের মতো। সর্দি হয়েছিল! বার বার টিসুতে নাক ঝাড়ছিল।
বাবা, খাঁটি সাহেব! আর তৃতীয় ভদ্রলোক?
আদৌ মনে রাখার মতো চেহারা নয়। তবে হ্যাঁ–নিরামিষাশী। উনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ভেজিটেবল থালি নিলেন ডিনার এবং লাঞ্চে।
ফেলুদা সব ব্যাপারটা খাতায় নাট করে চলেছে। শেষ হলে পর খাতা থেকে মুখ তুলে বলল, আর কিছু?
দীননাথবাবু মাথা নেড়ে বললেন, আর তো কিছু বলার মতো দেখছি না। দিনের বেলা বেশির ভাগ সময়ই আমার মন ছিল ওই লেখাটার দিকে। রাত্রে ডিনার খাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছি! ট্রেনে সচরাচর এত ভাল ঘুম হয় না। ঘুম ভেঙেছে একেবারে হাওড়ায় এসে, আর তাও মিস্টার পাকড়শী তুলে দিলেন বলে।
তার মানে আপনিই বোধহয় সব শেষে কামরা ছেড়েছেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আর তার আগেই অবিশ্যি আপনার ব্যাগ অন্যের হাতে চলে গেছে।
তা তো বটেই।
ভেরি গুড। ফেলুদা খাতা বন্ধ করে পেনসিলটা শার্টের পকেটে গুঁজে দিয়ে বলল, দেখি আমি কী করতে পারি।
দীননাথবাবু চেয়ার থেকে উঠে পড়ে বললেন, এ ব্যাপারে আপনার যা পারিশ্রমিক তা তো দেবই, তা ছাড়া আপনার কিছু ঘোরাঘুরি আছে, তদন্তের ব্যাপারে আরও এদিক ওদিক খরচ আছে, সেই বাবদ আমি কিছু ক্যাশ টাকা আপনার জন্য নিয়ে এসেছি।
ভদ্রলোক তাঁর পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা সাদা খাম বার করে ফেলুদার দিকে এগিয়ে দিলেন, আর ফেলুদাও দেখলাম বিলিতি কায়দায় ওঃ–থ্যাঙ্কস বলে সেটা দিব্যি পেনসিলের পিছনে পকেটে গুঁজে দিল।
দরজা খুলে গাড়ির দিকে এগোতে এগোতে ভদ্রলোক বললেন, আমার টেলিফোন নম্বর ডিরেক্টরিতেই পাবেন। কিছু খবর পেলেই কাইন্ডলি জানাবেন, এমনকী সটান আমার বাড়িতে চলেও আসতে পারেন। সন্ধে নাগাদ এলে নিশ্চয়ই দেখা পাবেন।
হলুদ রঙের হিস্পানো সুইজা তার গম্ভীর শাঁখের মতো হর্ন বাজিয়ে রাস্তায় জমা হওয়া লোকদের অবাক করে দিয়ে রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের দিকে চলে গেল! আমরা দুজনে বৈঠকখানায় ফিরে এলাম। যে চেয়ারে ভদ্রলোক বসেছিলেন, সেটায় বসে ফেলুদা পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে আড় ভেঙে বলল, এই ধরনের বনেদি মেজাজের লোক আজ থেকে পাঁচিশ বছর পরে আর থাকবে না।
বাক্সটা টেবিলের উপরই রাখা ছিল। ফেলুদা তার ভিতর থেকে একটা একটা করে সমস্ত জিনিস বার করে বাইরে ছড়িয়ে রাখল। অতি সাধারণ সব জিনিস। সুব মিলিয়ে পঞ্চাশ টাকার মালা হবে কি না সন্দেহ। ফেলুদা বলল, তুই একে একে বলে যা, আমি খাতায় নোট করে নিচ্ছি। আমি একটা একটা করে জিনিস টেবিলের উপর থেকে তুলে তার নাম বলে আবার বাক্সে রেখে দিতে লাগলাম, আর ফেলুদা লিখে যেতে লাগল। সব শেষে লিস্টটা দাঁড়াল এই রকম–
১। দু ভাঁজ করা দুটো দিল্লির ইংরেজি খবরের কাগজ-একটা Sunday Statesman আর 435 Sunday Hindusthan Times.
২। একটা প্রায় অর্ধেক খরচ হওয়া বিনাকাটুথপেস্ট। টিউবের তলার খালি অংশটা পেচিয়ে উপর দিকে তুলে দেওয়া হয়েছে