কার সঙ্গে হয়েছে সেটা জানা নেই বোধহয়? ফেলুদা প্রশ্ন করল।
অজ্ঞে না। সেটা জানা থাকলে বোধহয় আপনার কাছে আসার প্রয়োজন হত না।
বাকি তিনজনের নামও অবশ্যই জানা নেই?
একজন ছিলেন বাঙালি। নাম পাকড়াশী। দিল্লি থেকে আমারই সঙ্গে উঠলেন।
নামটা জানলেন কী করে?
অন্য আরেকটি যাত্রীর সঙ্গে তাঁর চেনা বেরিয়ে গেল। তিনি, হ্যালো মিস্টার পাকড়াশী বলে, তাঁর সঙ্গে আলাপ জুড়লেন। কথাবাতায় দুজনকেই বিজনেসম্যান বলে মনে হল। কনট্রাক্ট, টেন্ডার ইত্যাদি কথা কানে আসছিল।
যার সঙ্গে কথা হচ্ছিল তার নামটা জানতে পারেননি?
আজ্ঞে না। তবে তিনি অবাঙালি, যদিও বাংলা জানেন, আর মোটামুটি ভালই বলেন। কথায় বুঝলাম তিনি সিমলা থেকে আসছেন।
আর তৃতীয় ব্যক্তি? তিনি বেশির ভাগ সময় বাঙ্কের উপরেই ছিলেন, কেবল লাঞ্চ আর ডিনারের সময় নেমেছিলেন। তিনিও বাঙালি নন। দিল্লি থেকে ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণ পর তিনি আমায় একটা আপেল অফার করে বলেছিলেন সেটা নিজের বাগানের আন্দাজে মনে হয় তিনিও হয়তে সিমলাতেই থাকেন, আর সেখানেই তাঁর অরচার্ড!
আপনি খেয়েছিলেন আপেলটা?
হ্যাঁ, কেন খাব না। দিব্যি সুস্বাদু আপেল।
তা হলে ট্রেনে আপনি আপনার অসময়ের নিয়মটা মানেন না বলুন! ফেলুদার ঠোঁটের কোণে মিচকি হাসি।
ভদ্রলোক হা হা করে হেসে বললেন, সৰ্ব্বনাশ! আপনার দৃষ্টি এড়ানো তো ভারী কঠিন দেখছি। তবে আপনি ঠিকই বলেছেন। চলন্ত ট্রেনে সময়ের নিয়মগুলো মন সব সময় মানতে চায় না।
এক্সকিউজ মি, ফেলুদা বলল, আপনারা কে কোথায় বসে ছিলেন সেটা জানতে পারলে ভাল হত।
আমি ছিলাম একটা লোয়ার বার্থে। আমার উপরের বার্থে ছিলেন মিস্টার পাকড়াশী; উলটোদিকের আপার বাৰ্থে ছিলেন আপেলওয়ালা, আর নীচে ছিলেন অবাঙালি বিজনেসম্যানটি।
ফেলুদা কয়েক মুহূর্ত চুপ। তারপর হাত কচলে আঙুল মটকে বলল, ইফ ইউ ডোস্ট মাইন্ড-আমি একটু চা বলছি। ইচ্ছে হলে খাবেন, না হয় না। তোপসে, তুই যা তো চট করে। আমি এক দৌড়ে ভেতরে গিয়ে শ্ৰীনাথকে চায়ের কথা বলে আবার বৈঠকখানায় এসে দেখি, ফেলুদা অ্যাটাচি কেসটা খুলেছে।
চাবি দেওয়া ছিল না বুঝি? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
না। আমারটাতেও ছিল না। কাজেই যে নিয়েছে সে অনায়াসে খুলে দেখতে পারে ভেতরে কী আছে। এটার মধ্যে অবিশ্যি সব মামুলি জিনিস।
সত্যিই তাই। সাবান চিরুনি কুরুশ টুথব্রাশ টুথপেস্ট, দাড়ি কামানোর সরঞ্জাম, দুটো ভাঁজ করা খবরের কাগজ, একটা পেপার ব্যাক বই-এই সব ছাড়া বিশেষ কিছুই চোখে পড়ল না।
আপনার বাক্সে কোনও মূল্যবান জিনিস ছিল কি? ফেলুদা প্রশ্ন করল।
দীননাথবাবু বললেন, নাথিং। এ বাক্সে যা দেখছেন, তার চেয়েও কম মূল্যবান। কেবল একটা লেখা ছিল–একটা হাতের লেখা রচনা-ভ্ৰমণকাহিনী-সেটা ট্রেনে পড়ব বলে সঙ্গে নিয়েছিলাম। বেশ লাগছিল পড়তে। তিব্বতের ঘটনা।
তিব্বতের ঘটনা? ফেলুদার যেন খানিকটা কৌতুহল বাড়ল।
হ্যাঁ। ১৯১৭ সালের লেখা। লেখকের নাম শম্ভুচরণ বোস। যা বুঝছি, লেখাটা আসে আমার জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে। কারণ ওটা আমার জ্যাঠামশাইকে উৎসর্গ করা। আমার জ্যাঠামশাই হলেন সতীনাথ লাহিড়ী, কাঠমুণ্ডুতে থাকতেন। রাণাদের ফ্যামিলিতে প্রাইভেট টিউটরি করতেন। উনি অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে প্রায় অথর্ব অবস্থায় দেশে ফেরেন-পঁয়তাল্লিশ বছর আগে। তার কিছুদিন পরেই মারা যান। ওর সঙ্গেই জিনিসপত্তরের মধ্যে একটা নেপালি বাক্স ছিল। আমাদের বাড়ির বক্সরুমের একটা তাকের কোনায় পড়ে থাকত। ওটার অস্তিত্বই জানতাম না। সম্প্রতি বাড়িতে আরশোলা আর ইঁদুরের উপদ্রব বড্ড বেড়েছিল বলে পেস্ট কস্ট্রোলের লোক ডাকা হয়। তাদের জন্যই বাক্সটা নামাতে হয়। আর এই বাক্সটা থেকেই লেখাটা বেরোয়।
কবে?
এই তো—আমি দিল্লি যাবার আগের দিন।
ফেলুদা অন্যমনস্ক। বিড় বিড় করে বলল, শদ্ভুচরণ…শদ্ভুচরণ…
যাই হাক, মিস্টার লাহিড়ী বললেন, ওই লেখার মূল্য আমার কাছে তেমন কিছু নয়। সত্যি বলতে কী, আমি বাক্সটা ফেরত পাবার ব্যাপারে কোনও আগ্রহ বোধ করছিলাম না। আর এই যে বাক্সটা দেখছেন, এটারও মালিককে পাওয়া যাবে এমন কোনও ভরসা না দেখে এটা আমার ভাইপোকে দিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর কাল রাত থেকে হঠাৎ মনে হতে লাগল-এসব জিনিস দেখতে তেমন জরুরি মনে না হলেও, এর মালিকের কাছে এর কোনও কোনওটার হয়তো মূল্য থাকতেও পারে। যেমন ধরুন। এই রুমাল। এতে নকশা করে G লেখা রয়েছে। কে জানে কার সূচিকর্ম এই G? হয়তো মালিকের স্ত্রীর। হয়তো স্ত্রী আর জীবিত নেই! এই সব ভেবে মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল, তাই আজ আমার ভাইপোর ঘর থেকে বাক্সটা তুলে আপনার কাছে নিয়ে এলাম। সত্যি বলতে কী, আমারটা ফেরত পাই না-পাই তাতে আমার কিছু এসে যায় না, কিন্তু এ বাক্স মালিকের কাছে পৌঁছে দিলে আমি মনে শান্তি পাব।
চা এল। ফেলুদা আজকাল চায়ের ব্যাপারে ভীষণ খুঁতখুঁতে হয়ে পড়েছে। এ চা আসে কার্শিয়ঙের মকাইবাড়ি টি এস্টেট থেকে। পেয়ালা সামনে এনে রাখলেই ভুর ভুর করে সুগন্ধ বেরোয়। চায়ে একটা নিঃশব্দ চুমুক দিয়ে ফেলুদা বলল, বাক্সটা কি অনেকবার খোলার দরকার হয়েছিল ট্ৰেনে?
মাত্ৰ দুবার। সকালে দিল্লিতে ওঠার কিছুক্ষণের মধ্যেই লেখাটা বার করে নিই, আর রাত্রে ঘুমোবার আগে আবার ওটা ভেতরে ঢুকিয়ে রাখি।