বাবাকে চিঠি লিখে হাতে একটা গল্পের বই নিয়ে বৈঠকখানার সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে বাক্সের ব্যাপারটা সম্বন্ধে ভাবতে ভাবতে সমস্ত ঘটনাগুলো ক্ৰমেই। আরও ধোঁয়াটে হয়ে আসতে লাগল। দীননাথবাবু, তাঁর সেই ফিল্মে অ্যাকটিং করা ভাইপো, খিটখিটে নরেশ পাকড়াশী, আপেলওয়ালা, সিমলাবাসী মিস্টার ধমীজা, সুদের কারবারি বৃজমোহন, সবাই-যেন মনে হল মুখোশ পরা মানুষ। এমনকী, এয়ার ইন্ডিয়ার বাক্স আর তার ভিতরের প্রত্যেকটা জিনিসও যেন মুখোশ পরে বসে আছে। আর তার উপরে কাল রাত্রে প্রিটারিয়া স্ট্রিটের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা…
শেষটায় ভাবা ঘন্ধ করে তাক থেকে একটা পত্রিকা নিয়ে পাতা উলটাতে লািগলাম। সিনেমা পত্রিকা-নাম তারাবাজি। এই তো সেই পত্রিকা–যাতে আমরকুমারের ছবি দেখেছিলাম। এই তো—শ্ৰীগুরু পিকচার্সের নির্মীয়মাণ অশরীরী ছায়াচিত্রে নবাগত অমরকুমার। মাথায় দেব আনন্দের জুয়েল থিফের ধাঁচের টুপি, গলায় মাফলার, সরু গোঁফের নীচে ঠোঁটের কোণে যাকে বলে ক্রুর হাসি। হাতে আবার একটা রিভলভার—সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে ফাঁকি। নিশ্চয়ই কাঠের তৈরি।
হঠাৎ কী মনে হল, টেলিফোন ডিরেক্টরিটা খুলে একটা নাম বার করলাম। শ্ৰীগুরু পিকচার্স। তিপ্লান্ন নম্বর বেনটিষ্ক স্ট্রিট টু ফোর ফাইভ ফাইভ ফোর।
নম্বর ডায়াল করলাম। ওদিকে রিং হচ্ছে। এইবার টেলিফোন তুলল।
হ্যালো–
শ্ৰীগুরু পিকচার্স?
আমার গলাটা মাস ছয়েক হল ভেঙে মোটার দিকে যেতে শুরু করেছে, তাই আমার বয়স যে মাত্র সাড়ে পনেরো, সেটা নিশ্চয়ই এরা বুঝতে পারবে না।
হ্যাঁ, শ্ৰীগুরু পিকচার্স।
আপনাদের অশরীরী ছবিতে যে নবাগত আমারকুমার কাজ করছেন, তাঁর সম্বন্ধে একটু–
আপনি মিস্টার মল্লিকের সঙ্গে কথা বলুন।
লাইনটা বোধহয় মিস্টার মল্লিককে দেওয়া হল।
হ্যালো।
মিস্টার মল্লিক?
কথা বলছি।
আপনাদের একটা ছবিতে আমারকুমার বলে একজন নবাগত অ্যাকটিং করছেন কি?
তিনি তো বাদ হয়ে গেছেন–
বাদ হয়ে গেছেন?
আপনি কে কথা বলছেন?
আমি— কী নাম বলব কিছু ভেবে না পেয়ে বোকার মতো খট করে টেলিফোনটা নামিয়ে রেখে দিলাম। আমরকুমার, বাদ হয়ে গেছে! নিশ্চয়ই ওর গলার আওয়াজের জন্য। কাগজে ছবি-টবি বেরিয়ে যাবার পরে বাদ। অথচ ভদ্রলোক কি সে-খবরটা জানেন না? নাকি জেনেও আমাদের কাছে বেমালুম চেপে গেলেন?
বসে বসে এই সব ভাবছি। এমন সময় টেলিফোনটা হঠাৎ বেজে উঠে আমাকে বেশ খানিকটা চমকে দিল। আমি হস্তদন্ত রিসিভারটা তুলে হ্যালো বলার পর বেশ কয়েক সেকেন্ড কোনও কথা নেই। তারপর একটা খট করে শব্দ পেলাম! বুঝেছি। পাবলিক টেলিফোন থেকে কলটা আসছে। আমি আবার বললাম, হ্যালো। এবারে কথা এল–চাপা কিন্তু স্পষ্ট।
সিমলা যাওয়া হচ্ছে?
একটা অচেনা গলায় হঠাৎ কেউ এ প্রশ্ন করতে পারে এটা ভাবতেই পারিনি। তাই আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ঢোক গিলে চুপ করে রইলাম।
আবার কথা এল। খসখসে গলায় রক্ত-জলি-কল্প-কথা–
গেলে বিপদ। বুঝেছ? বিপদ।
আবার খট্। এবার টেলিফোন রেখে দেওয়া হল। আর কথা শুনব না। কিন্তু যেটুকু শুনেছি তাতেই আমার হয়ে গেছে। সেই নেশাখের রাণার হাতে বাঘ-মারা বন্দুক যেভাবে কাঁপত, ঠিক সেইভাবে কাঁপা হাতে আমি টেলিফোনটা রেখে দিয়ে চেয়ারের উপর কাঠ হয়ে বসে রইলাম!
প্রায় আধা ঘণ্টা পরে চেয়ারে বসা অবস্থাতেই আবার ক্রিং শুনে বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল, কিন্তু তারপরেই বুঝলাম এটা টেলিফোন নয়, কলিং বেল। তিন ঘণ্টা হয়ে গেছে দেখে নিজেই দরজা খুলতে ফেলুদা ঢুকল। তার হাতে পোল্লায় প্যাকেটটা দেখে বুঝলাম লক্তি থেকে আনা আমাদের দুজনের গরম কাপড়। ফেলুদা আমার দিকে একবার আড়াচোখে দেখে নিয়ে বলল, ঠোঁট চাটছিস কেন? কোনও গোলমেলে টেলিফোন এসেছিল নাকি?
আমি তো অবাক! কী করে বুঝলে?
রিসিভারটা যেভাবে রেখেছিস তাতেই বোঝা যাচ্ছে তা ছাড়া জটপাকানো কেস-ও রকম দু-একটা টেলিফোন না এলেই ভাবনার কারণ হত। কে করেছিল? কী বলল?
কে করেছিল জানি না; বলল, সিমলা গেলে বিপদ আছে।
ফেলুদা পাখাটা ফুল স্পিডে করে তক্তপোশের ওপর গা এলিয়ে দিয়ে বলল, তুই কী বললি?
কিচ্ছু না।
ইডিয়ট! তোর বলা উচিত ছিল যে আজকাল কলকাতার রাস্তাঘাটে চলতে গেলে যে বিপদ, তেমন বিপদ এক যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়া আর কোথাও নেই—সিমলা তো কোন ছার!
ফেলুদা হুমকিটা এমনভাবে উড়িয়ে দিল যে আমিও আর ও বিষয়ে কোনও উচ্চবাচ্য না করে বললাম, লন্ড্রি ছাড়া আর কোথায় গেলে?
এস এম কেদিয়ার আপিসে।
কিছু জানতে পারলে?
বৃজমোহন বাইরে মাইডিয়ার লোক! পরিষ্কার বাংলা বলে, তিন পুরুষ কলকাতায় আছে। নরেশ পাকড়াশীর সঙ্গে সত্যিই ওর লেনদেনের সম্পর্ক ছিল। মনে হল পাকড়শী এখনও কিছু টাকা ধারে। ধমীজার আপেল বৃজমোহনও খেয়েছিল। নীল এয়ার ইন্ডিয়ার ব্যাগ। ওর নেই। ট্রেনে বেশির ভাগ সময়টাই হয়। ঘুমিয়ে না হয় চোখ বুজে শুয়ে কাটিয়েছে।
আমার দিক থেকেও একটা খবর দেবার ছিল—তাই অমরকুমারের বাদ হয়ে যাওয়ার কথাটা ওকে বললাম। তাতে ফেলুদা বলল, তা হলে মনে হয় ছেলেটা হয়তো সত্যিই ভাল অভিনয় করে।
সারাদিন আমরা আমাদের গোছগাছটা সেরে ফেললাম! কাল আর সময় পাব না। কারণ ভোর সাড়ে চারটায় উঠতে হবে। মাত্র চারদিনের জন্য যাচ্ছি বলে খুব বেশি জামাকাপড় নিলাম না। সন্ধ্যা সাড়ে ছটার সময় জটায়ু অর্থাৎ লালমোহনবাবুর কাছ থেকে একটা টেলিফোন এল। বললেন, একটা নতুন রকমের অস্ত্ৰ নিয়েছি।–দিল্লি গিয়ে দেখাব। লালমোহনবাবুর আবার অস্ত্রশস্ত্র জমানোর শখ। রাজস্থানে একটা ভুজালি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন-যদিও সেটা কাজে লাগেনি। ভদ্রলোকের টিকিট কেনা হয়ে গেছে, বললেন, কাল সকলে সেই দমদমে দেখা হবে।