আমি আসছি বলে ফেলুদা তার ঘরে চলে যাবার পর আমাকে একা পেয়ে ভদ্রলোক বললেন, তোমার দাদাকে একটু গভীর দেখছি। কোনও কেস-টেস এসেছে নাকি?
আমি বললাম, সেরকম কিছু নয়, তবে একটা ব্যাপারে আমাদের সিমলা যেতে হচ্ছে।
সিমলা? কবে?
বাধহয় পরশু।
লং টুর?
না। দিন চারেক!
ইস, ওদিকটা দেখা হয়নি, বলে ভদ্রলোক একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন।
ফেলুদা ফিরে এলে পর ভদ্রলোক আবার নড়েচড়ে বসলেন। আপনারা সিমলা যাচ্ছেন। শুনলাম। কোনও তদন্ত আছে নাকি?
ঠিক তদন্ত নয়। রাম-শ্যামের বাক্স অদল-বদল হয়ে গেছে। শ্যামের বাক্স রামের কাছ থেকে নিয়ে শ্যামকে ফেরত দিয়ে, শ্যামের কাছ থেকে রামের বাক্স নিয়ে রামকে ফেরত দিতে হবে।
আরেব্বাস রে–বাক্স-রহস্য?
রহস্য কি না এখনও বলতে পারি না, তবে সামান্য দু-একটা খটকার ব্যাপার–
দেখুন স্যার, জটায়ু বাধা দিয়ে বললেন, এই কমাসে আপনাকে আমি খুব থরোলি চিনেছি। আমার ধারণা, একটা কিছু ইয়ে না থাকলে আপনি কক্ষনও কেসটা নিতেন না। ঠিক করে বলুন তো ব্যাপারটা কী।
ফেলুদার কথায় বুঝলাম সে এই স্টেজে লালমোহনবাবুকে তেমন খোলাখুলি কিছু বলতে চাইছে না। বলল, কে সত্যি কথা বলছে, আর কে সত্য গোপন করছে, আর কে মিথ্যে বলছে— এগুলো পরিষ্কার না-জানা অবধি কিছু খুলে বলা সম্ভব নয়। তবে গণ্ডগোল যে একটা রয়েছে সেটা—
ব্যাস ব্যাস—এনাফ! জটায়ুর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠেছে। তা হলে বলুন—আপনার অনুমতি পেলেই আপনাদের সঙ্গে লটকে পড়ি।
ঠাণ্ডা সয় ধাতে? ফেলুদা প্রশ্ন করল।
ঠাণ্ডা? দার্জিলিং গেছি লাস্ট ইয়ারে।
কোন মাসে?
মে।
সিমলায় এখন বরফ পড়ছে।
জটায়ু উত্তেজনায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।
বলেন কী, বর–ফ? গতবার ডেজার্ট আর এবার স্নো? ফ্রম দি ফ্লাইং প্যান টু দি ফ্রিজিডেয়ার? এ তো ভাবাই যাচ্ছে না মশাই!
ফেলুদা যদিও এসব কথা বলে জটায়ুকে নিরুৎসাহ করার চেষ্টা করছিল, ভদ্রলোক সহজে দমাবার পাত্র নন। খ্যাক খ্যাক করে ভিলেনের মতো একটা হাসি হেসে বললেন, খরচের ভয় কী দেখাচ্ছেন মশাই-একুশখানা রোমাঞ্চ উপন্যাস, প্রত্যেকটা কমপক্ষে পাঁচটা করে এডিশন, তিনখানা বাড়ি হয়ে গেছে। কালকেতা শহরে আপনাদের আশীর্বাদে। এসব ব্যাপারে খরচকে কেয়ার করি না মশাই। যত দেখব, তত প্লট আসবে মাথায়, তত বইয়ের সংখ্যা বাড়বে। আর সবাই তো ফেলুমিত্তির নয় যে জলহস্তী আর সিন্ধুঘোটকের তফাত ধরবে। যা লিখব তাই গিলবে, আর যত গিলবে ততই আমার লাভ। আমার লাভের রাস্তা আটকায় এমন কার সাধ্যি আছে মশাই? অবিশ্যি আপনি যদি সোজাসুজি নিষেধ করেন, তা হলে অবিশ্যি…
ফেলুদা নিষেধ করল না। লালমোহনবাবু যাবার আগে আমরা কবে যাচ্ছি, কদিনের জন্য যাচ্ছি, কী ভাবে যাচ্ছি ইত্যাদি জেনে নিয়ে একটা খাতায় নোট করে নিয়ে বললেন, একটা গরম গেঞ্জি, দুটো পুলোভার, একটা তুলোর কোিট আর তার উপর একটা ওভার কোট চাপালে শীত মানবে না বলচেন, অ্যাঁ?
ফেলুদা বলল, তার সঙ্গে এক জোড়া দস্তানা, একটা মাঙ্কি ক্যাপ, এক জোড়া গোলোস জুতো, গরম মোজা আর ফ্রস্ট-বাইটের ওষুধ নিলে খানিকটা নিশ্চিন্ত হতে পারেন।
ইস্কুলে পরীক্ষা দিতে মোটেই ভাল লাগে না, কিন্তু ফেলুদার কাছে যে পরীক্ষাটা দিতে হয় তাতে আমার কোনওই আপত্তি নেই। সত্যি বলতে কী, তার মধ্যে বেশ একটা মজা আছে, আর সেই মজার সঙ্গে মাথাটাও বেশ পরিষ্কার হয়ে যায়।
রাত্রে খাবার পরে ফেলুদা তার খাটে উপুড় হয়ে বুকে বালিশ নিয়ে শুয়েছে, আর আমি তার পাশে বসে পরীক্ষণ দিচ্ছি। অর্থাৎ, এই নতুন কেসটার বিষয়ে ওর নানা রকম প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিা!
প্রথম প্রশ্ন হল–এই বাক্স বদলের ব্যাপারে কার কার সঙ্গে আলাপ হল বল।
প্রথম দীননাথ লাহিড়ী।
বেশ। লোকটাকে কেমন মনে হয়!
ভালই তো। তবে বই-টই সম্বন্ধে বিশেষ খবর রাখে না। আর, এই যে এতগুলো টাকা খরচ করে আমাদের সিমলা পাঠাচ্ছেন, এই ব্যাপারে যেন একটু খটকা…
যে লোক দু-দুটো ওরকম ডাকসাইটে গাড়ি মেনটেন করতে পারে, তার আর যাই হাক, টাকাৰ অভাব নেই। তা ছাড়া ফেলুমিত্তিরকে এমপ্লয় করা তো একটা প্রেসটিজের ব্যাপারসেটা ভুললেও তো চলবে না।
তই যদি হয় তা হলে আর খটকার কিছু নেই। দ্বিতীয় আলাপ–নরেশচন্দ্ৰ পাকড়াশী। তিরিক্ষি মেজাজ।
কিন্তু স্পষ্টবক্তা। সেটা একটা গুণ। সকলের থাকে না।
কিন্তু সব কথা সত্যি বলেন কি? দীননাথবাবু কি সত্যিই এককালে লায়েক ছিলেন? মানে, রেসের মাঠে-টাঠে যেতেন?
এক কালে কেন, এখনও আছেন। তবে তার মানেই যে লোকটা খারাপ, এমন কোনও কথা নেই।
তারপর অমরকুমার। মানে প্রবীর লাহিড়ী। কাকাকে পছন্দ করেন না।
স্বাভাবিক। কাকা তার অ্যাম্বিশনে বাধা দিচ্ছে, তাকে একটা বাক্স দিয়ে আবার নিয়ে নিচ্ছে, রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক।
প্রবীরবাবুর শরীরটা বেশ মজবুত বলে মনে হল।
হ্যাঁ। হাতের কবজি চওড়া। তাই গলার আওয়াজটা আরও বেমানান লাগে।…এবার বল কালকা মেলের ফাস্ট ক্লাসের ডি কম্পার্টমেন্টের বাকি দুজন যাত্রীর কী নাম।
কেদিয়া। মাড়োয়ারি।
হ্যাঁ। সুদের ব্যবসা। সাধারণ চেহারা। নরেশ পাকড়াশীর সঙ্গে আগেই চেনা।
ভদ্রলোকের লেনিন সরণিতে সত্যিই আপিস আছে। টেলিফোন ডিরেক্টরিতে দেখেছি।
অন্যজন জি সি ধমীজা। সিমলায় থাকে। আপোলের চাষ আছে।।