- বইয়ের নামঃ বাক্স-রহস্য
- লেখকের নামঃ সত্যজিৎ রায়
- প্রকাশনাঃ নওরোজ কিতাবিস্তান
- বিভাগসমূহঃ ফেলুদা সমগ্র
০১. বাক্স রহস্য

বাক্স রহস্য । সত্যজিৎ রায়
ক্যাপ্টেন স্কটের মেরু অভিযানের বিষয়ে একটা দারুণ লোমখাড়া-করা বই এই সবে শেষ করেছি, আর তার এত অল্প দিনের মধ্যেই যে বরফের দেশে গিয়ে পড়তে হবে সেটা ভাবতেই পারিনি। অবিশ্যি বরফের দেশ বলতে কেউ যেন আবার নর্থ পোল সাউথ পোল ভেবে না বসে। ওসব দেশে কোনও মামলার তদন্ত বা রহস্যের সমাধান করতে ফেলুদাকে কোনওদিন যেতে হবে বলে মনে হয় না। আমরা যেখানে গিয়েছিলাম সেটা আমাদেরই দেশের ভিতর; কিন্তু যে সময়টায় গিয়েছিলাম তখন সেখানে বরফ, আর সে বরফ আকাশ থেকে মিহি তুলোর মতো ভাসতে ভাসতে নীচে নেমে এসে মাটিতে পুরু হয়ে জমে, আর রোদুরে সে বরফের দিকে চাইলে চোখ ঝলসে যায়, আর সে বরফ মাটি থেকে মুঠো করে তুলে নিয়ে বল পাকিয়ে ছোঁড়া যায়।
আমাদের এই অ্যাডভেঞ্চারের শুরু হয় গত মার্চ মাসের এক বিযুদিবারের সকালে। ফেলুদার এখন গোয়েন্দা হিসাবে বেশ নাম হয়েছে, তাই ওর কাছে মক্কেলও আসে মাঝে মাঝে। তবে ভাল কেস না হলে ও নেয় না। ভাল মানে যাতে ওর আশ্চর্য বুদ্ধিটা শানিয়ে নেওয়ার সুযোগ হয় এমন কেস। এবারের কেসটা প্রথমে শুনে তেমন আহামরি কিছু মনে হয়নি। কিন্তু ফেলুদার বোধহয় একটা আশ্চর্য ক্ষমতা আছে যার ফলে ও সেটার মধ্যে কীসের জানি গন্ধ পেয়ে নিতে রাজি হয়ে গেল। অবিশ্যি এও হতে পারে যে মক্কেল ছিলেন বেশ হামরা-চোমরা লোক, আর তাই ফেলুদা হয়তো একটা মোটা রকম দাঁও মারার সুযোগ দেখে থাকতে পারে। পরে ফেলুদাকে কথাটা জিজ্ঞেস করতে ও এমন কটমট করে আমার দিকে চাইল যে আমি একেবারে বেমালুম চুপ মেরে গেলাম।
মক্কেলের নাম দীননাথ লাহিড়ী। বুধবার সন্ধ্যাবেলা ফোন করে। পরদিন সকালে সাড়ে আটটায় আসবেন বলেছিলেন, আর ঠিক ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় একটা গাড়ি এসে থামার আওয়াজ পেলাম আমাদের তারা রোডের বাড়ির সামনে। গাড়ির হর্নটা অদ্ভুত ধরনের, আর সেটা শোনামাত্র আমি দরজার দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম। ফেলুদা একটা ইশারা করে আমায় থামিয়ে দিয়ে চাপা গলায় বলল, অত আদেখলামো কেন? বেলটা বাজুক।
বেল বাজার পর দরজা খুলে দিতে ভদ্রলোকের সঙ্গে সঙ্গে চোখ পড়ল তার গাড়িটার দিকে। এমন পোল্লায় গাড়ি আমি এক রোলস রয়েস ছাড়া আর কখনও দেখিনি। ভদ্রলোকের নিজের চেহারাটাও বেশ চোখে পড়ার মতো, যদিও সেটা তার সাইজের জন্য নয়। টকটকে ফরসা গায়ের রং, বয়স আন্দাজ পঞ্চান্নর কাছাকাছি, পরনে কোঁচানো ফিনফিনে ধুতি আর গিলে করা আদির পাঞ্জাবি, আর পায়ে সাদা শুড় তোলা নাগরা। এ ছাড়া বাঁ হাতে রয়েছে হাতির দাঁত দিয়ে বাঁধানো হাতলওয়ালা ছড়ি আর ডান হাতে রয়েছে একটা নীল চৌকো অ্যাটাচি কেস। এ রকম বাক্স আমি ঢের দেখেছি। আমাদের বাড়িতেই দুটো আছে-একটা বাবার, একটা ফেলুদার। এয়ার ইন্ডিয়া তাদের যাত্রীদের এই বাক্স বিনি। পয়সায় দেয়।
ভদ্রলোককে আমাদের ঘরের সবচেয়ে ভাল আর্ম চেয়ারটায় বসতে দিয়ে ফেলুদা তার উলটামুখে সাধারণ চেয়ারটায় বসল। ভদ্রলোক বললেন, আমিই কাল টেলিফোন করেছিলাম। আমার নাম দীননাথ লাহিড়ী।
ফেলুদা গলা খাকরিয়ে বলল, আপনি আর কিছু বলার আগে আপনাকে দুটো প্রশ্ন করতে পারি কি?
নিশ্চয়ই।
এক নম্বর–আপনার চায়ে আপত্তি আছে?
ভদ্রলোক দুহাত জোড় করে মাথা নুইয়ে বললেন, কিছু মনে করবেন না মিস্টার মিত্তির, অসময়ে কিছু খাওয়ার অভ্যাসটা আমার একেবারেই নেই। তবে আপনি নিজে খেতে চাইলে স্বচ্ছদে খেতে পারেন।
ঠিক আছে। দ্বিতীয় প্রশ্ন—আপনার গাড়িটা কি হিসাপানো সুইজা?
ঠিক ধরেছেন। এ জাতের গাড়ি বেশি নেই। এদেশে থার্টি ফোরে কিনেছিলেন আমার বাবা।
ফেলুদা একটু হেসে বলল, আমি অনেক ব্যাপারেই ইন্টারেস্টেড। অবিশ্যি সেটা খানিকটা আমার পেশার খাতিরেই।
আই সি। তা যাই হোক–যে জন্য আপনার কাছে আসা। আপনার কাছে ব্যাপারটা হয়তো তুচ্ছ বলে মনে হবে। আপনার রেপুটেশন আমি জানি, সুতরাং আপনাকে আমি জোর করতে পারি না, কেবলমাত্র অনুরোধ করতে পারি যে, কেসটা আপনি নিন।
ভদ্রলোকের গলার স্বর আর কথা বলার ঢঙে বনেদি ভাব থাকলেও, হামবড়া ভাব একটুও নেই। বরঞ্চ রীতিমতো ঠাণ্ডা আর ভদ্র।
আপনার কেসটা কী সেটা যদি বলেন…
মিস্টার লাহিড়ী মৃদু হেসে সামনে টেবিলের ওপর রাখা বাক্সটার দিকে দেখিয়ে বললেন, কেসও বলতে পারেন, আবার অ্যাটাচি কেসও বলতে পারেন…হেঁহেঁ। এই বাক্সটাকে নিয়েই ঘটনা।
ফেলুদা বাক্সটার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, এটা বার কয়েক বিদেশে গেছে। বলে মনে হচ্ছে। ট্যাগগুলো ছোড়া হলেও, ইলাস্টিক ব্যান্ডগুলো এখনও দেখছি হাতলে লেগে রয়েছে। এক, দুই, তিন…
ভদ্রলোক বললেন, আমারটার হাতলেও ঠিক ওইরকম রয়েছে।
আপনারটার…? তার মানে এই বাক্সটা আপনার নয়?
আজ্ঞে না, মিস্টার লাহিড়ী বললেন, এটা আরেকজনের। আমারটার সঙ্গে বদল হয়ে গেছে।
আই সি…তা কীভাবে হল বদল? ট্রেনে না প্লেনে?
ট্রেনে। কালকা মেলে। দিল্লি থেকে ফিরছিলাম। একটা ফাস্ট ক্লাস কমপার্টমেন্টে চারজন যাত্রী ছিলাম! তার মধ্যে একজনের সঙ্গে বদল হয়ে গেছে!