চুরির খবরটা পুলিশে দেননি?
সেই রাত্ৰেই। এখনও পর্যন্ত কোনও হদিস পায়নি।
গণেশের খবর বাইরের কেউ জানত?
উমানাথবাবু উত্তর দেবার আগেই বিকাশবাবুর সঙ্গে রুক্সিণীকুমার এসে হাজির হল। আমি ভেবেছিলাম ক্যাপ্টেম স্পার্কের ভাগ্যে বুঝি প্রচণ্ড ধমক আছে, কিন্তু দেখলাম উমানাথবাবু সেরকম লোক নন। শুধু আড়চাখে একবার ছেলের দিকে চেয়ে গভীর গলায় বললেন, কাল থেকে পুজোর কাঁটা দিন আর বাইরে যাবে না। বাড়িতে বাগান আছে, ছাত আছে–যত খুশি খেলতে পারো; ঘুড়ি আছে, ঘুড়ি ওড়াতে পারো, বই আছে পড়তে পারো, কিন্তু আমাদের সঙ্গে ছাড়া বাইরে বেরোবে না।
আর শয়তান সিং? ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করল রুক্মিণীকুমার!
সে আবার কে?—উমানাথবাবুর বা ভুরুটা উঠে গেছে উপর দিকে।
ও যে কারাগারের শিক ভেঙে পালিয়েছে।
ঠিক আছে, আমি ওর খবর এনে দেব তোমাকে, হালকাভাবে হেসে আশ্বাসের সুরে বললেন বিকাশবাবু। রুকু মনে হল খানিকটা ভরসা পেয়েছে। অন্তত সে তার শাস্তির ব্যাপারে। আর কোনও আপত্তি না করে বিকাশবাবুর হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
উমানাথবাবু বললেন, বুঝতেই পারছেন আমার পুত্রটি একটু অতিমাত্রায় কল্পনাপ্রবণ। যাই হোক।–আপনার প্রশ্নের জবাব দিই এবার-w-গণপতির খবর আমরা দেশে থাকতে অনেকেই জানত। ওটা একটা কিংবদন্তির মতো মুখে মুখে রটে গিয়েছিল। সেটা অবিশ্যি আমার জন্মের আগে। পরের দিকে এ নিয়ে আর বিশেষ কেউ আলোচনা করত না। আমার নিজের ছাত্রজীবন কাটে কলকাতায়। কলেজে থাকতে দু-একটি বন্ধুকে আমি গল্পচ্ছলে গণেশের কথা বলেছিলাম। তার মধ্যে একটি বন্ধু—অবিশ্যি এখন তাকে আর বন্ধু বলি না–সম্প্রতি কাশীতে রয়েছেন। তার নাম মগনলাল মেঘরাজ।
বুঝেছি, ফেলুদা বলল, তাঁকে আজ মছলিবাবার ওখানে দেখলাম। জানি।
আমি যেদিন গেছিলাম সেদিনও ছিল। তার বাবাজীর কাছে যাতায়াত করার একটা কারণ আছে। কিছুদিন থেকে তার ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে। খারাপের দিকে অবশ্যই। বছর দু-এক আগে ওর। প্লাইউডের ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগা থেকে এর শুরু।
তারপর এই গত কয়েক মাসের মধ্যে ওর গোলমেলে কারবার সম্বন্ধে অনেক গুজব বাজারে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ওর কলকাতার এবং বেনারসের বাড়িতে পুলিশ রেড হয়ে যায়। আমি এখানে আসার দুদিন বাদেই আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। সোজাসুজি বলল যে গণেশষ্টা ওরা দরকার। ওটা যে কলকাতায় আমার কাছে থাকে না, এখানে বাবার সিন্দুকে থাকে, সেটা ও জানত। চল্লিশ হাজার অবধি অফার করেছিল ওটার জন্য। আমি সোজাসুজি না বলে দিই। ও যাবার সময় শাসিয়ে যায় যে জিনিসটা ও হাত করে তবে ছাড়বে। তার ঠিক পাঁচদিন পরে গণেশ সিন্দুক থেকে উধাও হয়ে যায়।
ভদ্রলোক চুপ করলেন। ফেলুদাও চুপ, চিন্তিত। আমি জানি ওর তিনমাসের অবসর এখানেই শেষ হল। সামনের কাঁটা দিন কাশীই হবে ওর কাজের জায়গা, তদস্তর জায়গা। লালমোহনবাবুর ভবিষ্যদ্বাণী মনে পড়ছে-এক ঢিলে তিন পাখি। অবিশ্যি ক্যাশের ব্যাপারটা নির্ভর করছে।–
আমাদের খুব ভাগ্য ভাল যে আপনি ঠিক এই সময়ে এসে পড়লেন। আপনার উপর কাজের ভারটা দিতে পারলে–
নিশ্চয়ই। একশোবার! ফেলুদা উঠে দাঁড়িয়েছে।আপনি অনুমতি দিলে কাল সকালে একবার আসতে চাই। আপনার বাবার সঙ্গে একবার কথা বলা যাবে কি?
কোন যাবে না? বাবার তো এখন রিটায়ার্ড জীবন। অবিশ্যি বাবার মেজাজটা ঠিক যাকে বলে মোলায়েম তা নয়। তবে সেটা বাইরের খোলস। আর আপনি যদি আমাদের বাড়ির এদিক ওদিক ঘুরে দেখতে চান, তাও পারেন স্বচ্ছন্দে। আমি ত্ৰিলোচনকে বলে রাখব আপনাকে এলে যেন ঢুকতে দেয়। আর. বিকাশ রয়েছে, ও-ও সব ব্যাপারে। আপনাদের হেলপ করতে পারে। আটটা নাগাত এলে ভাল-তা হলে বাবাকে তৈরি অবস্থায় পাবেন।
বাড়ি ফেরার পথে পর পর দুটো অন্ধকার গলি দিয়ে আসবার সময় তিন তিনবার পায়ের আওয়াজ শুনে পিছন ফিরে চাদর মুড়ি দেওয়া একই লোককে দেখতে পেয়ে সেদিকে ফেলুদার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছিলাম; ও যে শুধু পাত্তাই দিল না তা নয়-সারা রাস্তা ধরে গুনগুন করে ইশক ইশক ইশক ছবির এমনিতেই একটা বাজে গান সমানে ভুল সুরে গেয়ে গেল।
০৪. ক্যালকাটা লজের ঠাকুর
ক্যালকাটা লজের ঠাকুর ফাউল কারিটা দিব্যি রেঁধেছিল। এ ছাড়া রুই মাছের কালিয়া ছিল, রান্নাও ভাল হয়েছিল, কিন্তু লালমোহনবাবু খেলেন না। বললেন, মছলিবাবাকে দেখার পর থেকে আর মাছ খেতে মন চায় না মশাই।
কেন? ফেলুদা বলল, খেলেই মনে হবে বাবাকে চিবিয়ে খাচ্ছেন? আপনার কি ধারণা বাবা নিজে মাছ খান না?
খান বুঝি?
শুনলেন তো বাবা জলেই থাকেন বেশির ভাগ সময়। জলে মাছ ছাড়া আর খাবার কী আছে বলুন! মাছেরাও যে মাছ খায় সেটা জানেন?
লালমোহনবাবু চুপ মেরে গেলেন। আমার বিশ্বাস কাল থেকে উনি আবার মাছ খাবেন।
সারাদিনের নানারকম ঘটনার পর রাত্রে একটা লম্বা ঘুম দেব ভেবেছিলাম, কিন্তু খানিকটা ব্যাঘাত করলেন রুম-মেট জীবনবাবু। জীবনবাবু মোটা, জীবনবাবু বেঁটে, জীবনবাবুর চাপ দাড়ি, আর জীবনবাবু বালিশে মাথা রাখার দশ মিনিটের মধ্যে নাক ডাকতে শুরু করেন। ভদ্রলোক একটা ডাক্তারি কোম্পানির রিপ্রেজেনটেটিভ, দুদিন হল এসেছেন, কালই সকালে চলে যাবেন। ফেলুদার সঙ্গে পরিচয় হবার এক মিনিটের মধ্যে ব্যাগ খুলে কোম্পানির নাম খোদাই করা একটা ডট পেন ফেলুদাকে দিয়ে দিলেন—যদিও সেটা ওকে অদ্বিতীয় গোয়েন্দা বলে চিনতে পারার দরুন কিনা বোঝা গেল না।