ওকে চেনেন? উনি হলেন মগনলাল মেঘরাজ। ওঁর মতো পয়সা আর দাপট কাশীতে আমার কারুর নেই। বেনারসে যদি বাঘ থাকত তো এখানকার বলদগুলোর সঙ্গে এক ঘাটে জল খেতি ওঁর নামে।
মগনলাল মেঘরাজ?…নামটা চেনাচেন মনে হচ্ছে।
নিরঞ্জনবাবু ফেলুদার দিকে আরও খানিকটা ঝুকে পড়লেন–আর সেই সঙ্গে আমিও।
দুবার পুলিশ রেড হয়ে গেছে। ওর বাড়িতে। একবার কলকাতায়-ওর বড়বাজারের গদিতে—একবার এখেনে। চোরা কারবার, কালো টাকা-যা ভাবতে চান ভাবুন না।
পুলিশ তো পায়নি কিছু—তাই না?
পুলিশ তো সব ওর হাতের মুঠোয় মশাই। রেড তো নামকাওয়াস্তে।
ভক্তের দল এখনও একজন একজন করে গিয়ে কাগজে নম্বর দিয়ে আসছে। দেখে মনে হয় বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগবে। আমরা আরও মিনিট পাঁচেক দেখে বাইরে বেরিয়ে এলাম। গেটের কাছে পৌঁছতে না পৌঁছতে পিছন থেকে একটা ডাক শুনে ঘুরে দেখি যার সঙ্গে নিরঞ্জনবাবু আমাদের আলাপ করিয়ে দিলেন, সেই মিস্টার সিংহ ব্যস্তভাবে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন।
আপনারা চললেন?-ভদ্রলোক বিশেষ করে ফেলুদার দিকে তাকিয়েই প্রশ্নটা করলেন। উত্তরে ফেলুদা কিছু বলার আগেই ভদ্রলোক বললেন, ইয়ে, আপনাদের এখনই একবারটি আমাদের বাড়ি আসা সম্ভব হবে কি? মিস্টার ঘোষাল আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারলে খুশি হতেন।
ফেলুদা হাতের ঘড়িটা দেখে নিয়ে বলল, আমাদের আর কী অসুবিধা বলুন। নিরঞ্জনবাবুকে অবিশিষ্ট হয়তো হোটেলে ফিরে যেতে হবে।
আপনারা তিনজনে ঘুরে আসুন, নিরঞ্জনবাবু বললেন, তবে বেশি রাত না করলে খাবারটা গরম গরম খেতে পারবেন—এইটে শুধু বলে রাখলাম। আজ। আপনাদের জন্য ফাউল কারি করতে বলিচি।
০৩. ভুবনেশ্বরের যক্ষীর ভাঙা মাথা
আপনার নাম আমি শুনেছি। আপনিই তো ভুবনেশ্বরের যক্ষীর ভাঙা মাথা উদ্ধার করে দিয়েছিলেন।–তাই না?
আজ্ঞে হ্যাঁ–ফেলুদা ওর পক্ষে যতটা সম্ভব বিনয়ী হাসি হেসে বলল। উমানাথ ঘোষালের বয়স চল্লিশের বেশি না, গায়ের রং ছেলেরই মতো টকটকে, চোখ দুটো কটা আর ঢুলু ঢুলু। কথা বলার সময় লক্ষ করলাম যে দুটো ভুরু এক সঙ্গে কখনই উপরে উঠছে না; একটা ওঠে তো অন্যটা নীচে থেকে যায়।
এঁরা সব আপনার–?-ভদ্রলোকের দৃষ্টি ফেলুদার দিক থেকে আমাদের দুজনের দিকে ঘুরে গেছে।
এটি আমার খুড়তুতো ভাই তপেশ, আর ইনি লালমোহন গাঙ্গুলী, জটায়ু ছদ্মনামে অ্যাড়তেঞ্চারের গল্প লেখেন।
জটায়ু?–উমানাথের ডান ভুরুটা উঠে গেল।নামটা চেনা চেনা লাগছে। রুকুর কাছে ওঁর কিছু বই দেখেছি বলে যেন মনে পড়ছে। তাই না হে বিকাশ?
আজ্ঞে হ্যাঁ, বললেন বিকাশবাবু, খান তিনেক আছে বোধহয়।
বোধহয় আবার কী। তুমিই তো যত রাজ্যের রহস্যের বই কিনে দাও ওকে।
বিকাশবাবু অপ্রস্তুত হাসি হেসে বললেন, ও ছাড়া ও আর কিছু পড়তেই চায় না।
এ বয়সে তো ও সব পড়বেই, পড়বেই, বলে উঠলেন লালমোহনবাবু। সকালে ক্যাপ্টেন স্পার্ক আর শয়তান সিং-এর নাম শোনা অবধি উনি বেশ মনমরা হয়ে ছিলেন; এখন আবার মুখে হাসি ফুটেছে। রহস্য রোমাঞ্চ বইয়ের বাজারে অক্রুর নদী নাকি জটায়ুর সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী।
ফেলুদা বলল, আমি এমনিতেই একটা কারণে আপনার কাছে আসতে চেয়েছিলাম।..আপনার ছেলের সঙ্গে আজ আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছে। তার আসল নামটা যদিও এখনও জানতে পারিনি, তবে সে যে ভূমিকায় অভিনয় করছিল তার নামটা জানি।
অভিনয়?–উমানাথবাবু হা হা করে হেসে উঠলেন। আরে ও যে শুধু নিজে অভিনয় করে তা তো নয়, অন্যদেরও যে নামটাম বদলে অভিনয় করায়। তোমাকেও একটা কী নাম দিয়েছিল না, বিকাশ?
মাত্র একটা? বিকাশবাবুও হেসে উঠলেন।
যাই হাক–তা, কোথায় দেখা হল আমার ছেলের সঙ্গে?
ফেলুদা কোনওরকম ঝাড়াবাড়ি না করে অল্প কথায় অত্যন্ত গুছিয়ে সকালের ঘটনাটা উমানাথবাবুকে বলল। ভদ্রলোক শুনে প্রায় চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন।
কী সৰ্ব্বনাশের কথা!!–ছেলে আমার ডানপিটে সে তো জানি; তা বলে তার এতটা দুঃসাহস সে তো জানতাম না; ও তো মরতে মরতে বেঁচে গেছে! রুকুকে একবার ডেকে পাঠাও তো হে বিকাশ।
মিস্টার সিংহ ছেলেটির খোঁজে বেরিয়ে গেলেন। ফেলুদা বলল, ডাকনাম রুকু সে তো জানলাম। ভাল নামটা কী?
রুক্মিণীকুমার, বললেন উমানাথবাবু।ও-ই আমার একমাত্র ছেলে; কাজেই ঘটনাটা শুনে আমার মনের অবস্থা কী হচ্ছে সে তো বুঝতেই পেরেছেন।
দুৰ্গাকূণ্ড রোডের উপর বিরাট কম্পাউন্ডের মধ্যে বিশাল বাড়ি ঘোষালদের। রাত্রে বাড়ির বাইরেটা ভাল করে দেখতে পাইনি—শুধু গেটের উপর মার্বেল ফলকে লেখা শংকরী-নিবাস নামটা দেখেছি। আমরা বসেছি। একতলার বৈঠকখানায়। আমাদের ডান পাশে দরজা দিয়ে পুজোর দালান দেখা যাচ্ছে। আমি যেখানে বসেছি সেখান থেকে প্রতিমার আধখানা দেখতে পাচ্ছি। রং করার কাজ এখনও চলেছে।
চাকর ট্রেতে করে চা-মিষ্টি এনে আমাদের সামনে টেবিলে রেখে যাবার পর উমানাথবাবু বললেন, আপনারা মছলিবাঝা দর্শনে গিয়েছিলেন শুনলাম। কী মনে হল দেখেটেখে?
ফেলুদা একটা পেড়ার আধখানা কামড় দিয়ে মুখে ফেলে বলল, আমরা অল্পক্ষণই ছিলাম; শুনলাম। আপনিও নাকি যাচ্ছেন?
যাচ্ছি মানে একবারই গেছি। দ্বিতীয়বার যাবার আর বাসনা নেই, কারণ সেদিন আমি না-থাকার জন্যেই দুর্ঘটনা ঘটল।
উমানাথবাবু চুপ করলেন। আমরাও চুপ। লালমোহনবাবু দেখলাম আড়চোখে একবার ফেলুদার দিকে দেখে নিলেন।