ভজন গাইছে। গানের প্রথম দুটো লাইন মনে ছিল, হোটেলে ফিরে এসে খাতায় লিখে রেখেছিলাম—-
ইতিনী বিনতি রঘুনন্দন সে
দুখ দ্বন্দ্ব হামারা মিটাও জী—
আজ আর সেই মাছের আঁশের ব্যাপারটা হচ্ছে না। তার বদলে আজ একটা বিশেষ ঘটনা ঘটবার কথা আছে; মছলিবাবা আজ তার ভক্তদের কাছ থেকে জেনে নেবেন আর ক’দিন পরে তাঁকে কাশী ছেড়ে চলে যেতে হবে। সেটা যে কী ভাবে জানা হবে তা এখনও কেউ জানে না।
লালমোহনবাবুর দেখছি বেনারসে এসেই ভক্তিভাবটা একটু বেড়ে গেছে। সকালে দশাশ্বমেধ ঘাটে ওঁকে বার তিনেক বেশ গলা উচিয়ে জয় বাবা বিশ্বনাথ বলতে শুনেছি। এখানে এসে দেখছি বাবাজীকে দেখেই ওঁর হাত দুটো আপনা থেকেই জোড় হয়ে গেছে। এত ভক্তি দেখালে অ্যাডভেঞ্চার গল্পের প্লট মাথায় কী করে আসবে জানি না! বোধহয় ভাবছেন মছলিবাবা ওঁকে স্বপ্নে প্লট দিয়ে দেবেন।
কালো প্যান্ট আর নীল রঙের গুরু, শার্ট পরা একজন ভদ্রলোক সবেমাত্র আমাদের পিছন দিয়ে ঢুকে আমাদেরই পাশে দাঁড়িয়ে বোধহয় ভাবছেন ভিড় ঠেলে কী করে এগোনো যায়। নিরঞ্জনবাবু লোকটির দিকে ঝুকে পড়ে বললেন, ঘোষাল সাহেব এলেন না? ভদ্রলোক গলা নামিয়ে উত্তর দিলেন, আজ্ঞে না, ওনার খুড়তুতো ভাই আর তার স্ত্রী এসে পৌঁছেছেন। আজ দুৰ্গপুর থেকে, বাড়িতে তাই…
ভদ্রলোকের রং ফরসার দিকে, জুলপিটা হাল ফ্যাশানের, চোখে চশমা, সব মিলিয়ে মোটামুটি চালাক চতুর চেহারা।আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।–নিরঞ্জনবাবু ফেলুদার দিকে চেয়ে বললেন-ইনি বিকাশ সিংহ-উমানাথবাবুর সেক্রেটারি।
তারপর আমাদের তিনজনেরও পরিচয় করিয়ে দিলেন নিরঞ্জনবাবু। ফেলুদার নাম শুনেই সিংহি মশাইয়ের ভুরুটা কুঁচকে গেল।
প্রদোষ মিত্র? গোয়েন্দা প্রদোষ মিত্ৰ?
হ্যাঁ মশাই,–নিরঞ্জনবাবু গলা চাপতে ভুলে গেলেন—স্বনামধন্য ডিটেকটিভ। আর ইনিও অবিশ্যি কম ইয়ে নন–
নিরঞ্জনবাবু লালমোহনবাবুর দিকে দেখানো সত্ত্বেও সিংহ মশাইয়ের দৃষ্টি ফেলুদার দিকেই রয়ে গেল। ভদ্রলোক কী যেন বলতে চাইছেন।
ইয়ে আপনি এখানে আছেন জানলে…কোথায় উঠেছেন বলুন তো?
আমারই হোটেলে মশাই।–নিরঞ্জনবাবু এবার খেয়াল করে গলাটা নামিয়ে কথাটা বুললেন।
ঠিক আছে, মানে… বিকাশবাবু এখনও আমতা-আমতা করছেন–একবারটি বোধহয়. ঠিক আছে, কাল না হয় যোগাযোগ করব।
ভদ্রলোক নমস্কার করে ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলেন।
এক ব্ৰহ্ম, এক সূর্য, এক চন্দ্র।
মছলিবাবা দুহাত তুলে চেঁচিয়ে উঠছেন। ভজন থেমে গেল। ভক্তরা সবাই থমকে গিয়ে সোজা হয়ে বসল। এতক্ষণ লক্ষ করিনি, এবার দেখলাম। বাবার যেদিকে অভয়বাবু বসেছেন। তার উলটোদিকে আরেকটি ভদ্রলোক—বছর চল্লিশোক বয়স-সামনে একটা নকশা করা থলি নিয়ে বসেছেন। থলির পাশে স্তুপ করে কালো কালো কী জানি রাখা রয়েছে।
দু হাত দু পা দু চোখ দুকান!— বাবাজী আবার শুরু করলেন। এ সব বলার কী মানে কিছুই বুঝতে পারছি না; অন্যেরা কেউ বুঝছে কি না তাও বুঝতে পারছি না।
তিন কুল তিনি কাল চার দিক চার যুগ পঞ্চ ভূত পঞ্চ ইন্দ্ৰিয় পঞ্চ নন্দ পঞ্চ পাণ্ডব-এক, দো, তিন, চার, পাঁচ!
বাবাজী একটু থামলেন। থলিওয়ালা ভদ্রলোক তার দিকে হাঁ করে চেয়ে আছেন, ভক্তরাও সব চেয়ে আছে। লালমোহনবাবু আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন, খ্রিলিং। বাবাজী আবার শুরু করলেন–
ছে রিপু ছে ঋতু, সপ্ত সুর সপ্ত সিন্ধু, অষ্ট ধাতু অষ্ট সিদ্ধি, নবরত্ন নবগ্রহ, দশকর্ম দশ মহাবিদ্যা দশাবতার দশাশ্বমেধ-এক থেকে দশ।
এইটুকু বলে বাবাজী থলিওয়ালা ভদ্রলোকের দিকে ইশারা করলেন। ভদ্রলোক ফিসফিস করে বাবাজীকে কী যেন বলে দিলেন। তারপর ভক্তদের দিকে ফিরে অস্বাভাবিক রকম সরু গলায় বললেন, এবার আপনারা এক থেকে দশের মধ্যে একটি সংখ্যা বেছে নিয়ে একে একে বাবাজীর সামনে এসে এই থলির মধ্যে থেকে একটি কাগজের টুকরো নিয়ে তাতে এই কাঠকয়লার সাহায্যে সংখ্যাটি লিখে আমার হাতে দিয়ে দেবেন। প্ৰথমে বাংলায় বলে আবার সেটা হিন্দি করে বললেন।
ফেলুদা নিরঞ্জনবাবুর দিকে ঝুকে পড়ে বলল, যে সংখ্যাটা সবচেয়ে বেশি বার পড়বে, সেটাই কি বলে দেবে বাবা ক’দিন থাকবেন?
হয়তো তাই। সেটা তো বললে না কিছু!
যদি তাই হয় তা হলে বোধহয় বাবাজীর সাতদিনের বেশি মেয়াদ নেই।
আপনি লিখবেন নাকি?
না মশাই। বাবা থাকছেন কি যাচ্ছেন সে নিয়ে তো আমাদের অন্ত মাথাব্যথা নেই। আমরা দেখতে এসেছি, দূর থেকে দেখে চলে যাব-ব্যস। তবে একটা জিনিস জানার কৌতূহল হচ্ছে। এইসব ভক্তদের মধ্যে কিছু কিছু গণ্যমান্য লোকও আছেন তো, নাকি সবাই সাজানো ভক্ত?
কী বলছেন মশাই।—নিরঞ্জনবাবুর চোখ কপালে উঠে গেল।এরা সব বলতে পারেন। একেবারে ক্রিম অফ কাশী। ওই দেখুন–সাদা চাদর গায়ে, মাথায় টাক-উনি হলেন শ্রুতিধর মহেশ বাচস্পতি, মহাপণ্ডিত—আজন্ম কাশীতে রয়েছেন। তারপর ওই দেখুন মৃত্যুঞ্জয় সেন কবিরাজ, দয়াশঙ্কর শুক্লা–এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের এজেন্ট। যিনি বাবাজীর পাশে থালি নিয়ে বসে আছেন তিনি হলেন অভয় চক্কোক্তির ভাইপো-আলিগড় ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজির প্রোফেসার। উকিল ব্যারিস্টার ডাক্তার প্রোফেসর হালুইকর—কিছু বাদ নেই মশাই। আর মহিলা কত আছেন সে তো দেখতেই পাচ্ছেন। আর ওই দেখুন–
নিরঞ্জনবাবু একজন সাদা পাঞ্জাবি আর সাদা বেনারসি টুপি পরা জাঁদরেল লোকের দিকে দেখলেন।