ছেলেটি হঠাৎ পাঁচিল থেকে নেমে উধাও। ভাবছি। এবার কী নাটক দেখব কে জানে, এমন সময় হঠাৎ দেখি একটা বাঁশ হলদে বাড়ির পাঁচিলের উপর দিয়ে বেরিয়ে সামনের লাল বাড়ির ছাতের দিকে এগিয়ে গিয়ে দুই বাড়ির মাঝখানে একটা ব্রিজ তৈরি করল। এইবার ফেলুদা মুখ খুলল, যদিও গলার স্বর চাপা।
ওনার মতলবটো কী?
শয়তান সিং —আবার হুঙ্কার। তুমি দশ গুনতে গুনতে আমি তোমার কাছে এসে পড়ব।
এবার যেটা ঘটল তাতে আমাদের সকলেরই ঘাম ছুটে গেল।
ছেলেটি পাঁচিল থেকে কার্নিশে নেমে খপ করে বাঁশটা ধরে শূন্যে ঝুলে পড়ল।
এক…দুই…তিন…চার…
উলটা দিকের ছাত থেকে শয়তান সিং গুনতে শুরু করেছে, আর এ ছেলেটি বাঁশ ধরে বুলতে ঝুলতে এগোচ্ছে।
একটা কিছু করুন মশাই। নিরঞ্জনবাবু ধরা গলায় বললেন,—আমার কলিক পেনটা আবার–
ফেলুদার ডান হাতের তর্জনীটা গোখরোর ফোঁস করার মতো এক লাফে ঠোঁটে চলে এল। আমরা সবাই দম বন্ধ করে এই খুদে ছেলের দুঃসাহসিক ব্যাপারটা দেখতে লাগলাম।
ছয়…সাত…আট…ন—য়!
নয় গোনার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটি উলটো দিকে পৌঁছে গিয়ে কার্নিশে পা ফেলেই বাঁশেরই উপর ভর করে পাঁচিল টপকে লাল বাড়ির ছাতে নেমে গেল। তারপর শোনা গেল একটা অচেনা গলায় এক বিকট চিৎকার, আর সেই সঙ্গে প্রথম ছেলেটির এক অদ্ভুত হাসি।
।লালমোহনবাবু বললেন, মেরেই ফেললে নাকি মশাই?—কোমরে যেন ছারা গোছের কী একটা বুলিতে দেখলুম।
ফেলুদা গলির দিকে পা বাড়িয়ে বলল, ভিলেনটি কীরকম জানি না, হিরোটি যে দুর্দান্ত সাহসী তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
নিরঞ্জনবাবু বললেন, ঘোষাল বাড়িতে রিপোর্ট করা ছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই।
আমরা আরেকটু এগোতেই লাল বাড়িটার দরজার সামনে পৌঁছে গেলাম। ভিতরে অন্ধকার। কাছেই বোধহয় সিঁড়ি, কারণ ধুপ ধাপ পায়ের শব্দ পাচ্ছি, আর সেই সঙ্গে ছেলেটির কথা এগিয়ে আসছে।
…তারপর ঝপাৎ করে পড়বে জলে, আর ভাসতে ভাসতে ভাসতে ভাসতে চলে যাবে একেবারে সমুদ্রে, আর সেখানে একটা হাঙর এসে টপ করে গিলে ফেলবে। আর সেই হাঙরটা যখন ক্যাপ্টেন স্পার্কের দিকে চার্জ করবে, তখন ক্যাপ্টেন স্পার্ক হারপুন দিয়ে ঘ্যাচাং করে মারবে সেটার পেটে, আর—
এইটুকু বলে আর বলা হল না, কারণ ঘামে চপ চপা ছেলে দুটি দরজা দিয়ে বাইরে এসে পড়েছে, আর প্রথম ছেলেটি আমাদের দেখেই থমকে দাঁড়িয়েছে। বয়স বছর দশের বেশি। নয়, ধপধাপে। ফরসা রং, চোখ নাক একেবারে রাজপুত্তরের মতো। অন্য ছেলেটির বয়স কিছুটা বেশি। ইনি যে বাঙালি নন। সেটা দেখলেই বোঝা যায়। দুজনেরই চোয়াল যেভাবে চলছে তাতে বোঝাই যায় তারা মুখে চুইং গাম পুরে নিয়েছে।
ফেলুদা প্রথম ছেলেটিকে বলল, ও-তো শয়তান সিং আর তুমি কে?
ক্যাপ্টেন স্পার্ক, চাবুকের মতো উত্তর দিল ছেলেটি।
তোমার আরেকটা নাম আছে না? তোমার বাবা তোমাকে কী বলে ডাকেন?
আমার নাম ক্যাপ্টেন স্পার্ক। আমার বাবাকে বিষাক্ত তীর মেরে খুন করেছিল শয়তান সিং আফ্রিকার জঙ্গলে। তখন আমার বয়স সাত। তখন থেকে আমার চোখে প্ৰতিহিংসার বিদ্যুৎ জ্বলে, তাই আমার নাম স্পার্ক।
সর্বনাশ, বললেন লালমোহনবাবু, এ যে অক্রুর নদীর বই মুখস্থ করে ফেলেছে মশাই!
ছেলেটি লালমোহনবাবুর দিকে একবার কাঁটমট করে তাকিয়ে তার বন্ধুকে নিয়ে গভীরভাবে গলি দিয়ে এগিয়ে গিয়ে মোড় ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
বর্ন অ্যাকটর–মন্তব্য করলেন জটায়ু।
ফেলুদা নিরঞ্জনবাবুকে জিজ্ঞেস করল, ঘোষাল বাড়িতে কাউকে চেনেন?
চিনব না? অ্যাদ্দিন রয়েছি কাশীতে। ওদের সকলেই চেনে। প্ৰায় একশো বছর হল বেনারসে বাস। এই যে খোকাকে দেখলেন, এর ঠাকুরদা অম্বিকা ঘোষাল এখানেই থাকেন। ওকালতি করতেন, বছর খানেক হল ছেড়ে দিয়েছেন। খোকার বাপ উমানাথ ঘোষাল কলকাতায় থাকেন, কেমিক্যালের ব্যবসা। প্রত্যেক পুজোয় ফ্যামিলি নিয়ে এখেনে আসেন। এদের বাড়িতেই দুৰ্গাপুজো হয়। খানদানি পরিবার মশাই। এদের জমিদারি ছিল। ইস্টবেঙ্গলে পদ্মার ধারে।
একবার উমানাথের সঙ্গে দেখা করা যায়?
কেন যাবে না। আপনারা তো আবলুসবাঝা দর্শনে যাবেন বলছিলেন, সেখানেও দেখা হয়ে যেতে পারে। শুনাচি নাকি ইনিও দীক্ষা নেবেন নেবেন করচেন।
আবলুসবাবাকে দেখে নিরঞ্জনবাবুর নামকরণের তারিফ না করে পারা যায় না। ফেলুদা দেখেছে কি না জানি না, আমি নিজে জীবনে এত মিশকালো লোক দেখিনি। শুধু কালো নয়, এমন মসৃণ কালো যে হঠাৎ দেখলে মনে হয়, গায়ে বুঝি সাপের খোলসের মতো একটা কিছু পরে আছেন। তার উপরে কাঁধ অবধি ঢেউ খেলানো চুল, আর বুক অবধি ঢেউ খেলানো দাড়ি-দুটোই কুচকুচে কালো। সাধুবাবা জোয়ান লোক; বয়স ত্রিশ-পয়ত্ৰিশের বেশি হলে আশ্চর্য হর। অবিশ্যি জোয়ান না হলে আর এত সাঁতার কাটেন কী করে। বাবার চেহারা আরও খোলতাই হয়েছে তার গায়ের টকটকে লাল সিস্কের চাদর আর লুঙ্গির জন্য।
আমরা চারজন উঠনে ভক্তদের ভিড়ের পিছনে দাঁড়িয়েছি, বাবাজী বারান্দায় শীতল-পাটির উপর বিছানো একটা সাদা চাদরে বসেছেন, তার দু পাশে দুটো আর পিছনে একটা হলদে। মখমলের তাকিয়া। বাবার বাঁ পাশে একজন বৃদ্ধ চোখ বুজে হাত জোড় করে বসে আছেন, বোঝাই যাচ্ছে ইনি হলেন অভয় চক্রবর্তী। বাবা নিজে পদ্মাসনের ভঙ্গিতে বসে। অল্প অল্প দুলছেন, আর ডান হাতের তোলো দিয়ে হাঁটুতে হাত বুলোচ্ছেন। দোলানিটা হচ্ছে তালে তালে, কারণ বারান্দার এক ধারে বসে একজন লোক কাঠের খঞ্জনি বাজিয়ে একটা হিন্দুস্থানি