ঠিক বলেছ। ক্যাপ্টেন স্পার্ক, ওরফে আমাদের রুকুবাবু। –আচ্ছা, ক্যাপ্টেন স্পার্ক, সেদিন যখন তোমার বাবার সঙ্গে একজন মোটা ভদ্রলোক এ ঘরে বসে কথা বলছিলেন–
রুকু ফেলুদার কথা শেষ না হতেই চেঁচিয়ে উঠল—ডাকু গণ্ডারিয়া -ক্যাপ্টেন স্পার্ক তাকে বার বার বোকা বানায়।
সে যখন কথা বলছিল, তুমি কি তখন ওই পাশের ঘর থেকে শুনছিলে?
রুকু তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল, শুনছিলাম তো। আর তক্ষুনি তো সিন্দুক খুলে গণেশ নিয়ে লুকিয়ে রাখলাম। না হলে তো ও নিয়ে নিত।
ভেরি গুড, ফেলুদা বলল। তারপর অন্যদের দিকে ফিরে বলল, আমি ক্যাপ্টেন স্পার্ককে গণেশের কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। তাতে ও বলেছিল। গণেশ পাওয়া যাবে না। করুণ সেটা রয়েছে আফ্রিকার এক রাজার কাছে! কথাটার মানে আমি তখন বুঝতে পারিনি। শেষে বুঝলাম একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে-প্টয়তাল্লিশ বছরের পুরনো টার্জনের একটা ফিল্ম দেখতে গিয়ে।
ফেলুদা থামতেই চারিদিক থেকে–সে কী! অ্যাঁ? টার্জনের ছবি? ইত্যাদি অনেকগুলো প্রশ্ন একসঙ্গে শোনা গেল! ফেলুদা সরাসরি উত্তর না দিয়ে আবার রুকুর দিকে তাকিয়ে বলল, ক্যাপ্টেন স্পার্ক, টারজানের ছবির এক্কেবারে শুরুটা কী সেটা মনে করে বলতে পার তুমি!
পারি, বলল রুকু, মেট্রো-গোল্ডউইন-মেয়ার প্রেজেন্টস—
ঠিক কথা-মিস্টার তেওয়ারি, দেখুন তো আমরা মেট্রো-গোন্ডউইনের খেলা কিছু দেখাতে পারি কি না।
তেওয়ারি তার চেয়ারের নীচ থেকে একটা খবরের কাগজের মোড়ক নিয়ে সেটা খুলে তার থেকে একটা অদ্ভুত জিনিস বার করে ফেলুদার দিকে এগিয়ে দিল। তার উপরে বিজলির ঝাড়ের আলোটা পড়তেই বুঝলাম সেটা একটা জলে নষ্ট হয়ে যাওয়া মাটির তৈরি হাঁ-করা সিংহের মাথা! ফেলুদা মাথাটা হাতে তুলে ধরে বলল, এই দেখুন আফ্রিকার পশুরাজ তথা দুৰ্গরি বাহনের মাথা। এই সিংহের হাঁ-এর মধ্যে গণেশ লুকিয়ে রেখেছিল। ক্যাপ্টেন স্পার্ক। তার ধারণা ছিল বিসর্জনের পর গণেশ ভাসতে ভাসতে চলে যাবে সমুদ্রে, আর সেখানে একটি হাঙর সেটাকে গ্রাস করবে, আর স্পার্কই আবার সেই হাঙরকে হারপুন দিয়ে মেরে গণেশটাকে পুনরুদ্ধার করবে। তাই না, ক্যাপ্টেন স্পার্ক?
তাই তো, বলল রুকু।
আর মছলিবাবার প্ল্যান ছিল তিনি ঠাকুর ভাসানের আগে নিজে জলে ঝাঁপ দেবেন। তারপর কিছু দূর সাঁতরে গিয়ে আবার ডুব সাঁতারে ফিরে আসবেন ঘাটের দিকে-এসে নীকের আড়ালে অপেক্ষা করবেন। তারপর ভাসানের পরমুহূর্তে আবার ডুব দিয়ে সিংহের মাথাটি চাড় দিয়ে খুলে নিয়ে চলে যাবেন মুনশীঘাট আর রাজঘাটের মাঝামাঝি একটা নির্জন জায়গায়। ততক্ষণে মগনলালের বজরাও এসে যাবে সেইখানে। ব্যস-বাকি কাজ তো সহজ।
উমানাথবাবু বললেন, কিন্তু বাবাজী যে দস্যেরার দিনে যাবেন, সে তো তার ভক্তরাই ঠিক করে দিয়েছিল। আর গণেশ কোথায় আছে সে খবরই বা বাবাজী জানবেন কী করে? আর মগনলালই বা জানবে কী করে?
দুটোর উত্তরই খুব সহজ, বলল ফেলুদা।তৃতীয়ার দিনে বাবাজী তাঁর ভক্তদের জিজ্ঞেস করেন এক থেকে দশের মধ্যে একটা নম্বর বলতে। যথারীতি অধিকাংশ উত্তরই হয় সাত। এটাই নিয়ম। ফলে হয়ে গেল তিনে সাতে দশ-অর্থাৎ দিসেরা। আর সিংহের মুখে গণেশ লুকোনোর কথাটা ক্যাপ্টেন স্পার্ক সবাইকে না বললেও, তার বন্ধু সূরযকে নিশ্চয়ই বলেছিল, তাই না, ক্যাপ্টেন স্পার্ক?
রুকু স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে, তার ভুরু কুঁচকে গেছে। সে ছোট্ট করে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে দিল।
ফেলুদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, শয়তান সিং সত্যিই শয়তান সিং। সূরায্যের পুরো নাম সূরফলাল মেঘরাজ। সে মগনলালের ছাট ছেলে। যাকে বলে বাপকা বেটা। থাকত মানমন্দিরের কাছে মগনলালের দুটো বাড়ির একটাতে। ওটায় ফ্যামিলি থাকত। অন্যটায় থাকত মগনলাল নিজে। সূরযই তার বাপকে খবরটা দেয়, এবং তার পরেই মগনলাল তার বিরাট চক্রান্তটি খাড়া করে।
বিশ্বাসঘাতক! —বলে উঠল রুকু।
এতক্ষণে অম্বিকাবাবু মুখ খুললেন—
সিংহের মাথাটা তো টেবিলের উপর রেখে দিয়েছে, কিন্তু গণেশ কই?
ফেলুদা মাথাটাকে আবার হাতে তুলে নিল। তারপর তার হাঁ-করা মুখের ভিতর হাত ঢুকিয়ে টান দিয়ে যে জিনিসটা বার করল সেটা গণেশ নয় মোটেই। সেটা তার আঙুলের ভগায় লেগে থাকা চটচটে একটা সাদা জিনিস।
ক্যাপ্টেন স্পার্ক গণেশটাকে আটকাতে একটা আশ্চর্য সহজ উপায় বার করেছিল।
চিকলেট!–বলে উঠল রুক্মিণীকুমার।
হ্যাঁ, চুইং গাম, বলল ফেলুদা, সেই চুইং গামের খানিকটা এখনও রয়ে গেছে, কিন্তু গণেশ আর এখানে নেই।
ফেলুদার এই এক কথাতেই ঘোষাল বাড়ির সকলের মুখ কালো হয়ে গেল। উমানাথবাবু কপাল চাপড়ে বলে উঠলেন, তা হলে এত করে কী হল মিস্টার মিত্তির? গণেশই নেই?
ফেলুদা সিংহের মাথাটা আরেকবার নামিয়ে রেখে বলল, আমি আপনাদের আশায় ঠাণ্ডা জল ঢেলে দেবার জন্য আপনাদের এখানে ডাকিনি, মিস্টার ঘোষাল। গণেশ আছে। সেটা কোথায় বলার আগে আমি আপনাদের একটি ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। আপনাদের একজন খুব পরিচিত ব্যক্তির মৃত্যুর কথা! শশীভূষণ পাল।
তাকে তো তার ছেলে মেরেছে বলে উঠলেন। উমানাথবাবু, সেই নিয়েছে নাকি গণেশ?
ব্যস্ত হবেন না, বলল ফেলুদা, আমার কথাটা আগে মন দিয়ে শুনুন। আমি যা বলতে যাচ্ছি সেটা প্রমাণসাপেক্ষ, এবং সে প্রমাণ আমরা পাব বলেই আমার বিশ্বাস।