সর্বনাশ!—আরও কিছু বুঝলেন নাকি?
তাকের উপর প্রসাধনের জিনিসের মধ্যে শেভিং-এর সরঞ্জামের অভাবটা অৰ্থপূর্ণ নয় কি? অবিশ্যি যদি ইনি মাকুন্দ হয়ে থাকেন তা হলে আলাদা কথা, না হলে বলব দাড়ি-গোঁফ অবশ্যম্ভাবী।
হারকিষণের আনা চায়ের কপি হাতে নিয়ে তিনজন ঘরের উত্তর দিকের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। যে-রাস্তার উপরে বারান্দা, সেটাই পুব দিকে চলে গেছে সোজা দশাশ্বমেধ ঘাটে। রাস্তার দুদিকে সারি সারি দোকানে হিন্দি আর ইংবিজিতে লেখা সাইনবোর্ড। ফেলুদা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, তোপসে, তোকে যদি বলা যায় কলকাতার পাট উঠিয়ে এখানে এসে ধাবিক জীবনটা কাটাতে হবে-পারবি?
একটু ভেবে বললাম, বোধহয় না।
কিন্তু এখানে এসেছিস মনে করেই মনটা নেচে উঠছে—তাই নয় কি?
সত্যিই তাই। কাশীতে সারাজীবন থাকতে ভাল লাগবে না নিশ্চয়ই, কিন্তু যখনই ভাবছি আট-দশ দিনের বেশি থাকবার দরকার নেই তখনই মন বলছে বেনারসের মতো জায়গা হয় না।
তার কারণটা কী জানিস?-ফেলুদা বলল-তুই যে নীচের দিকে তাকিয়ে শুধু একটা রাস্তা দেখছিস তা তো নয়; তুই দেখছিন্স বেনারসের রাস্তা। বেনারস : কাশী! বারাণসী!-চারটিখানি কথা নয়। পৃথিবীর প্রাচীনতম শহর, পুণ্যতীর্থ পীঠস্থান : রামায়ণ মহাভারত মুনিঋষি যোগী সাধক হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ জৈন সব মিলে এই বেনারসের একটা ভেলকি আছে যার ফলে শহরটা নোংরা হয়েও ঐতিহ্যে ঝলমল করতে থাকে। যারা এখানে বসবাস করে তারা দিন গুজরানোর চিস্তায় আর এ সব কথা ভাববার সময় পায় না, কিন্তু যারা কয়েক দিনের জন্য বেড়াতে আসে তারা এইসব ভেবেই মশগুল হয়ে থাকে।
লালমোহনবাবু এই ফাঁকে কখন জানি ভিতরে চলে গিয়েছিলেন, হঠাৎ তাঁর গলার আওয়াজ পেয়ে পিছন ফিরে দেখি তিনি সঙ্গে একজন অচেনা লোককে নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। বছর পঞ্চাশেক বয়স, মাঝারি রং, মাথার কাঁচাপাকা চুল মাঝখানে সিঁথি করে পিছন দিকে টান করে আচড়ানো। চোখা নাকের নীচে পাতলা পান-খাওয়া ঠোঁট অল্প হাসিতে ফাঁক হয়ে আছে। ভদ্রলোক ফেলুদাকে নমস্কার করে বললেন, আপনার পরিচয় পেলুম এনার কাছ থেকে। আমার হাটেলের সম্মান বাড়ল, হেঃ হেঃ।
বুঝলাম ইনিই হলেন ম্যানেজার নিরঞ্জন চক্রবর্তী।
কোনও অসুবিধা-টসুবিধা–?
না না।–দিব্যি ব্যবস্থা।
আসুন, নীচে আসুন আমার ঘরে। আপনাদের চা দিয়েছে? শুধু চা? অ্যাঃ-ছিছি।
দেয়ালে তিনটে ইংরিজি আর দুটো বাংলা ক্যালেন্ডার, আর রবীন্দ্রনাথ সুভাষ বোস বিবেকানন্দ আর শ্ৰীঅরবিন্দর ছবি টাঙানো। ম্যানেজারের ঘরে বসে আমরা আরেক কাপ চা আর হালুয়া সোহন খেলাম। এ ঘরটা বাড়ির ভিতরের দিকে, তাই সাইকেল রিকশার হর্ন ছাড়া রাস্তার আর কোনও শব্দই আসে না।
নিরঞ্জনবাবু বললেন, আমার হোটেলে গত মার্চ মাসে বিশ্বশ্ৰী গুণময় বাগচী থেকে গেচেন-ওই আপনাদের তিন নম্বর ঘরটাতেই। ওঃ—কী মাস্ল মশাই! আদ্দির পাঞ্জাবি পরে গোধূলিয়ার মোড়ে পান। কিনতে গেচে, আর তিন মিনিটে রাস্তায় ভিড় জমে গেচে। হাত ভাঁজ করে পান মুখে পুরচে আর তাতেই বাইসেপ ঠেলে বেরুচ্ছে।..আপনি কিন্তু যাবার আগে আমাদের অ্যালবামে দু লাইন লিখে দিয়ে যাবেন। অনেক গুণী লোকের লেখা রয়েছে ওতে। তবে মাগ্যির বাজার, বোঝেন তো—মনের মতো মেনু দিতে পারব না। আপনাদের, এই যা দুঃখ।
ফেলুদা বলল, আপনি শুধু আমার লেখা চাইছেন কেন-ইনিও কিন্তু খ্যাক্তিতে কম যান না।
লালমোহনবাবু বিনয় করার ভাব করে কী একটা বলতে গিয়েও বললেন না। নিরঞ্জনবাবু হেসে বললেন, ওঁর কথা আমার ভায়রা ভাই আগেই জানিয়েচিল। আপনার আসাটা সারপ্রাইজ কিনা, তাই বলচি আর কী।
লালমোহনবাবু কিছুক্ষণ থেকেই উসখুস করছিলেন, এবার আর থাকতে না পেরে বললেন, কাগজে দেখলুম—এখানে একটি সাধুবাবার আবির্ভাব হয়েছে?
কে, আবলুস বাবা?
কই না তো। আবলুস তো নয়। মছলি-বাবা নাম দিয়েছে যে কাগজে।
ওই হল। হিন্দিওয়ালারা মছলি বলছে। আবলুস নাম আমার দেওয়া। গিয়ে দেখলে বুঝবেন নামকরণটা কেমন হয়েছে।
সত্যিই সাঁতরে এসেছেন নাকি?
প্রশ্নগুলো লালমোহনবাবুই করছেন, ফেলুদা শ্রোতা। নিরঞ্জনবাবু বললেন, তাই তো বলচে। বলে, এখন নাকি প্ৰয়াগ থেকে আসচেন; তবে স্টার্টিং পয়েন্ট হল গিয়ে হরিদ্বার। এখেন থেকে যাবেন মুঙ্গেরু-পাটনা। তারপর এক’দিন হয়তো দেখবেন বাবুঘাটে গিয়ে নোঙর ফেলেচেন বাবাজী?
অলৌকিক ক্ষমতার ব্যাপারটা কী মশাই?
যা শুনিচি তাই বলচি। কেদার ঘাটে চিতপাত হয়ে পড়ে ছিলেন বাবাজী। ভোর রাত্তিরে অভয় চক্কোত্তি ঘাটে নেমেছেন। পয়ত্ৰিশ বছরের অভ্যোস মশাই—ঘড়ি ধরে সাড়ে চারটে—ফাস্ট ঢুঁ অ্যারাইভ—শীত গ্ৰীষ্ম বিষৰ্ণ কোনও তফাত নেই। সত্তর বছর বয়স, চোখে ছানি। পা ফেলতে গিয়ে শানের বদলে নরম নরম কী ঠেকেছে, ঝুকে দেখেন মানুষ। গায়ের চামড়া কুঁচকানো, মনে হয় অনেকক্ষণ জলে ছিল। লোকটা এপাশ ওপাশ করছিল—যেন বেইশ অবস্থা থেকে সবে জ্ঞান ফিরচে। চক্কোত্তি মশাই ঘাড় নিচু করে দেখাচেন, এমন সময় বাবাজী চোখ খুলে তাঁর দিকে চেয়ে হিন্দি টানে বাংলা ভাষায় বললেন, মা এত জল দিয়ে ঘিরে রেখেছে তোকে, তাও তার আগুনের ভয়?—ব্যস, ওই এক কথাতেই অভয় চক্কোত্তি কাত।
আমরা তিনজনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি দেখে নিরঞ্জনবাবু ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলেন।