দুপুরে মিস্টার ঘোষাল ওঁদের বাড়িতে খেতে বলেছিলেন ২ ফেলুদা হোটেল থেকে ফোন করে বিকাশবাবুকে অ্যাপলজি জানিয়ে দিল। আমরা হাটেলেই খেলাম! ফেলুদা দু বেলাই হাতের রুটি খায়। আজ হঠাৎ একগাদা ভাত খেয়ে বিছানায় শুয়ে এক ঘুমে সাড়ে চারটি বাজিয়ে দিল। পরে বুঝেছিলাম যে ঝড়ের আগে প্রকৃতির যে একটা মাদামারা ভাব হয়, এ হল তাই; কিন্তু ফেলুদাকে কক্ষনও এরকম অকেজো আর ঝিমধরা অবস্থায় দেখিনি বলে। মনটা ভীষণ খারাপ লাগছিল।
লালমোহনবাবু অবিশ্যি ঠিক অকেজো ছিলেন না; তাঁর খাতায় তিনি একটা গল্পের খসড়া আরম্ভ করে দিয়েছেন গতকাল থেকে। দু লাইন লিখছেন আর সিলিং-এর দিকে চাইছেন। খালি একবার আমার দিকে ফিরে বললেন,মুমূৰ্হতে কী আডারে হ্রস্ব-উ দীর্ঘ-ঊ আসছে বলবে কাইন্ডলি?
শেষ পর্যন্ত টারজান দি এপ ম্যানও যাওয়া হল, কিন্তু ফেলুদার আর পুরো ছবিটা দেখা হল না। পুরো কেন বলছি-মেট্রো-গোল্ডউইন মেয়ারের নামের পর ছবির নামটা সবে পদায় পড়েছে, এমন সময় ফেলুদা দেখি সিট ছেড়ে উঠে পড়েছে।
তোপসে, তোরা থাক। আমার একটু কাজ আছে।
কিছু বলার আগেই ফেলুদা হাওয়া।
আমার মনের অবস্থা অদ্ভুত। ছবিটাও ভাল লাগছে ফেলুদার মধ্যে হঠাৎ কেন জানি উৎসাহ জেগে উঠেছে, সেটাও ভাল লাগছে, অথচ ও যে কীসের জন্য চলে গেল সেটা ভেবে পাচ্ছি না।
আটটার সময় ছবি শেষ হল; রিকশা নিয়ে হোটেলে ফিরলাম সোয়া আটটায়। ঘরে এসে দেখি ফেলুদা খাটে বসে খাতা খুলে ভীষণ মনোযোগ দিয়ে কী সব যেন হিসাব করছে। আমাদের দেখে বলল, তোরা খেয়ে নিস। আমার জন্য এক পেয়ালা কফি পাঠিয়ে দিতে বলেছি।
তুমি খাবেই না?
পেট ভরা। তা ছাড়া তেওয়ারির কাছ থেকে একটা জরুরি টেলিফোন আসছে।
আজ অষ্টমী বলে হোটেলে লুচি মাংস ছিল, রান্নাও ভাল হয়েছিল, কিন্তু পাছে তেওয়ারির ফোন আসার আগে খাওয়া শেষ না হয় তাই সব কিছু গোগ্রাসে গিলতে হল।
ফোনটা এল আমাদের খাওয়া শেষ হওয়ার প্রায় আধা ঘণ্টা পরে। এবার আমি ফেলুদার কাছে না থেকে পারলাম না। ফেলুদা যা বলল তা হচ্ছে এই—
বলুন মিস্টার তেওয়ারি…হাঁ…ভেরি গুড.না না, এখন কিছু করবেন না, একদম শেষ মুহূর্তে…হ্যাঁ, সেই জন্যেই তো গোড়ায় এত গণ্ডগোল লেগেছিল…হ্যাঁ–আর ইয়ে-ওই বাড়িটার খোঁজ করেছিলেন?…ভেরি গুড.ঠিক আছে, কাল দেখা হবে…গুড নাইট।
লালমোহনবাবু আমার সঙ্গে নীচে যাননি। সিনেমা থেকে ফেরার পথেই আমাকে বলেছিলেন, তোমার দাদার আজকের তিড়িংবাজির ঠেলায় আমার প্লটের খেই হারিয়ে গেছে; আবার নতুন করে সব সাজাতে হবে। ঘরে ফিরে এসে দেখি তিনি খাতা খুলে মুখ বেজার করে বসে আছেন। ফেলুদা ফিরে এসে একটা সিগারেট ধরিয়ে ঘরের মধ্যেই পায়চারি শুরু। করে দিল।
লালমোহনবাবু খাতা বন্ধ করে বললেন, খুব খারাপ হচ্ছে এটা, জানেন তো? না পারছি আমার গল্প এগোতে, না পারছি আপনার কেসের সঙ্গে পাল্লা দিতে। এদিকেও একটু ছিটেফোটা ছাড়ুন। আমাদেরও তা ব্রেন বলে একটা জিনিস আছে। একটু খাটাবার সুযোগ দিন!
কোনও আপত্তি নেই, ফেলুদা একটা ধোঁয়ার রিং ছেড়ে বলল, আপনাকে পাঁচটা সুতো দিচ্ছি, তা দিয়ে আপনি যত খুশি জাল বুনুন।
সুতো?
অ্যাফ্রিকার রাজা, শশীবাবুর সিং, হাঙরের মুখ, এক থেকে দশ, আর মগনলালের বজরা।
লালমোহনবাবু কিছুক্ষণ ফেলুদার দিকে চেয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তার চেয়ে বললেই পারতেন চন্দ্ৰবিন্দুর চ, বেড়ালের তালব্য শ, আর রুমালের মা। সে বরং ঢের সহজ হত।
কিন্তু একটা কথা আমাদের দিতে হবে আপনাদের-ফেলুদা হঠাৎ সিরিয়াস-কাল থেকে আর কোনও ব্যাপারে কোনও প্রশ্ন করতে পারবেন না।
একটা করেই যা জবাব পেলুম–আবার প্রশ্ন?
ফেলুদা লালমোহনবাবুর রসিকতা অগ্রাহ করে বলে চলল, কাল থেকে আমাকে হয়তো মাঝে মাঝে বেরোতে হতে পারে, তবে আপনাদের সঙ্গে না। আপনারা দুজনে যেখানে খুশি যেতে পারেন; আমার মনে হয় না। তাতে কোনও রিস্ক আছে। যদি তেমন বুঝি তা হলে আগে থেকেই বাইরে যেতে বারণ করব।..আর লালমোহনবাবু সাঁতার জানেন তো?
সাঁত–?
জলে নেমে ভেসে থাকতে পারেন তো?
হাঁ হ্যাঁ-ফর্টি-ফোরে হেদোতে–
ওতেই হবে। —অবিশ্যি সাঁতারের যে প্রয়োজন হবেই তা বলছি না।
পরের দিন নবমী! সকালে চা খেয়ে আমি আর লালমোহনবাবু বেরিয়ে পড়লাম। ফেলুদা বলল ও হাটেলেই থাকবে, কারণ ফোন আসতে পারে। লালমোহনবাবুর এক্কা চড়ার শখ—এদিকে কাশীতে আজকাল ঘোড়ার গাড়ি মানে বেশির ভাগ টাঙ্গা। অনেক খুঁজে শেষে একটা এক্কা পাওয়া গেল। সোনারপুরা রোড দিয়ে হিন্দু ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত গিয়ে দুগাকুণ্ড রোড দিয়ে ফেরার পথে মন্দির মসজিদ প্রাসাদ যা কিছু পড়ে সব দেখে সাড়ে এগারেটার সময় আমরা হোটেলে ফিরে এসে দেখি ফেলুদা বালিশ বুকের তলায় রেখে খাটের ওপর শুয়ে খুব মন দিয়ে তার তোলা কয়েকটা ছবির কোয়ার্টর সাইজ এনলার্জমেন্ট দেখছে; পরশু। বেঙ্গলি ক্লাবে যাবার পথে ও ক্রাউন ফোটো স্টোর্সে ওর ফিল্মটা দিয়ে। গিয়েছিল।
বিকেলের দিকে তেওয়ারির টেলিফোন এল; ফেলুদা মিনিট দুয়েকের মধ্যেই কথা শেষ করে উপরে চলে এল। বাড়িতে বসে থাকতে ভাল লাগছিল না, তাই আমি আর লালমোহনবাবু মণিকর্ণিকার শ্মশান দেখে এলাম। লালমোহনবাবু যাবার ও ফেরার পথে বার তিনেক বললেন, আজ আর কেউ ফলো করছে বলে মনে হচ্ছে না।