কোথায় যাচ্ছি মশাই আমরা?–আরও মিনিট পাঁচেক অলিগিলিতে হাঁটার পর লালমোহনবাবু প্রশ্নটা করলেন।
জানি না।
আমি আর লালমোহনবাবু পরস্পরের দিকে চুইলাম। সব সময় যে চাইলেই এ-ওর মুখ দেখতে পাচ্ছি তা নয়, কিন্তু ঠিক এই সময়টাতে একটা রাস্তার আলো মাথার উপর এসে পড়ায় লালমোহনবাবুর ভ্যাবাচ্যাক ভাবটা বুঝতে অসুবিধা হল না।
উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটলেও অনেক সময় মাথা খোলে, বলল ফেলুদা, এখানে মাথা খোলাটাই উদ্দেশ্য।
খুলছে কী?
একটা ইঁদুর যদি মানুষ হয়ে যেত তা হলে বোধহয় লালমোহনবাবুর প্রশ্নটা এই ভাবেই করত। ফেলুদা কী উত্তর দিত। জানি না, কারণ ঠিক এই সময়ে একটা ঘটনা ঘটাতে আমাদের মনটা অন্য দিকে চলে গেল।
এতক্ষণ এ-মোড় ও-মোড় ঘুরে আমরা যে গলিটায় পৌঁছেছিলাম সেটা একটু বিশেষ রকম নির্জন। কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত আশেপাশের বাড়িগুলোর ভিতর থেকে মানুষের গলার স্বর পেয়েছি, বাচ্চার কান্নার শব্দ পেয়েছি, রেডিয়ো থেকে গানের আওয়াজ পেয়েছি। এবারের গলিটায় দূর থেকে ভেসে আসা মন্দিরের ঘণ্টা ছাড়া আর কোনও শব্দই নেই। একটু এগোতে শোনা গেল তার সঙ্গে আরেকটা শব্দও একটানা এক তালে হয়ে চলেছে-ধুপ ধুপ ধুপ ধুপ ধুপ ধুপ…
লালমোহনবাবু আমাদের দুজনের মাঝখানে হাঁটছিলেন; শব্দটা শুনে দুদিকে হাত বাড়িয়ে আমাদের কোটের আস্তিন ধরে মৃদু টান দিয়ে হাঁটার স্পিড কমিয়ে দিলেন। তারপর ফিস ফিস করে বললেন হাইলি সাসপিশাস্।
ফেলুদা নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ওটা সাসপিশাসি কিছু না; পানের তবক তৈরি হচ্ছে। সাস পিশাস হচ্ছে, ওইটে।
এবার দেখলাম একটি লোককে আমাদের থেকে হাত পঞ্চাশেক দূরে। সে একটা মোড় ঘুরে সবেমাত্র এ গলিটায় ঢুকেছে।
লোকটা এগিয়ে এসে আমাদের দেখেই যেন থমকে দাঁড়িয়ে গেল। তার মুখে আলো পড়েনি, তাই এতদূর থেকে তাকে চেনা যাবে না; রাস্তার আলোটা তাঁর পিছন দিকে। সেই আলো তার পিঠে পড়াতে একটা প্ৰকাণ্ড লম্বা ছায়া সারা গলি জুড়ে প্রায় আমাদের পা অবধি পৌঁছে গেছে।
ছায়াটা অদ্ভুতভাবে দুলছে। লোকটা মাতাল নাকি?
ফেলুদা টেলিফোটা সমেত ক্যামেরাটা চোখে লাগাল।
শশীবাবু।
নামটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই ফেলুদা বিদ্যুদ্বেগে দৌড়ে গেল সামনের দিকে। তিনজন প্রায় একসঙ্গেই গিয়ে পৌঁছলাম শশীবাবুর কাছে। ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখে চেয়ে আছেন। শশীবাবু ফেলুদার দিকে, তার ঠোঁট দুটো ফাঁক দেখে মনে হয় তিনি কিছু বলতে চাইছেন।
কিছু বলবেন?-ফেলুদা ঝুকে পড়ে চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল।
হাঁ…হাঁ…
কী হয়েছে শশীবাবু? কী বলতে চাইছেন আপনি?
সিং, সিং, সিং।
শশীবাবুর দেহটা সামনের দিকে এলিয়ে পড়ল।
তার পিঠে আলো পড়েছে।
সেই আলোতে দেখলাম শশীবাবুর পিঠে একটা ক্ষত থেকে রক্ত বেরিয়ে তার পাঞ্জাবির অনেকখানি ভিজিয়ে দিয়েছে।
০৯. গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দেব
গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দেব রে।
ফেলুদা এ ধরনের কথা আগে কোনওদিন বলেনি, কিন্তু এবার যে অবস্থায় পড়েছে, তাতে এটা বলা বোধহয় খুব অস্বাভাবিক নয়।
আজ সপ্তমী। সোমবার। এখন সকাল। শশীবাবু খুন হয়েছেন দুদিন আগে। আমরা সকালে চা রুটি ডিম খাওয়া সেরে আমাদের হোটেলের ঘরে যে যার খাটে বসে আছি। একটুক্ষণ আগে তেওয়ারি ফোন করে জানিয়েছেন যে শশীবাবুর ছোট ছেলে নিতাইকে নাকি অ্যারেস্ট করা হয়েছে। নিতাই খারাপ ছেলে এটা আগেই শুনেছি। তার সঙ্গে নাকি বাপের অনবরত খিটিমিটি লাগত। শশীবাবু নাকি প্রায়ই ওকে পুলিশে ধরিয়ে দেবার ভয় দেখাতেন! তাই ছেলের পক্ষে শেষ পর্যন্ত বাপকে খুন করাটা অস্বাভাবিক নয়। নিতাই কিন্তু খুন স্বীকার করেনি। সে নাকি সেদিন সন্ধেবোলা চৈতগঞ্জের একটা সিনেমায় হিন্দি ছবি দেখছিল। তার শার্টের পকেটে টিকিটের আধখানা পাওয়া গেছে। যে ছুরি দিয়ে শশীবাবুকে খুন করা হয়েছিল সেটা নাকি পাওয়া যায়নি।
মৃত্যুর দিন সন্ধ্যা ছাঁটার মধ্যে শশীবাবু চক্ষুদানের কাজ শেষ করে দেন। বিকাশবাবু পুলিশকে বলেছেন যে কাজটা শেষ করেই শশীবাবু বিকাশবাবুর কাছে যান হোমিওপ্যাথিক ওষুধ চাইতে, কারণ তার নাকি আবার নতুন করে জ্বর এসেছিল। বিকাশবাবু ওষুধ দেন, শশীবাবু তখনই ওষুধ খেয়ে বাড়ি যাবার জন্য বেরিয়ে যান। পথেই তাকে খুন করা হয়।
মাঝে মাঝে বোধহয় এ ধরনের একটা ধাক্কা খাওয়া ভাল।—ফেলুদা আবার কথা বলছে। আমি জানি কথাটা ঠিক আমাদের উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে না। ফেলুদা যেটা করছে। তাকে ইংরেজিতে বলে থিংকিং অ্যালাউড। — বেশ লাগছে নিজেকে একটা সাধারণ স্তরের মানুষ বলে মনে করতে। —লালমোহনবাবু, আজ কাবুলিওয়ালা দেখতে যাবেন তো? এরা শুনেছি বেশ ভাল অভিনয় করে।
হ্যাঁ তা আপনি গেলে, মানে আপনি যদি…
আর কাল যাব টারজান। পরশু জঞ্জীর; তরুণ্ড রফু চক্কর। আর দুগাবাড়িটাও একবার দেখিয়ে আনব্য আপনাদের। দেখবেন ওখানকার বাঁদরগুলো ফেলুমিত্তিরের চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান।
সত্যি সন্ধ্যাবেলা আমরা কাবুলিওয়ালা দেখতে বেঙ্গলি ক্লাবে হাজির হলাম, আর সত্যই দেখলাম ওরা বেশ ভাল অ্যাকটিং করে।
অন্য বাড়িতে পুজো হয়। গোটা পাঁচেক ঠাকুর দেখে আমরা দুৰ্গর্বিাড়িতে গেলাম। লালমোহনবাবু মন্দিরের বাইরে রইলেন, কারণ বাঁদর জিনিসটা নাকি ওঁর খাঁচার বাইরে ভাল লাগে না। বললেন, ব্যাসদেব, থুড়ি—বাল্মীকিদেব যে কেন জানোয়ারটাকে জাতে তুলেছেন তা আজ পর্যন্ত বুঝতে পারলাম না। যারা লাঠির খোঁচা না খেলে নাচতে পারে না তারা করবে। সেতুবন্ধন? ছেঃ!—আর আমার গপপোকে বলা হয় গাঁজাখুরি!