সাড়ে চারটে নাগাত বৃষ্টি থেমে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল। পাঁচটার সময় আমরা তিনজন হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম। আজকে ফেলুদা পুরোপুরি টুরিস্ট, কারণ তার কাঁধে ক্যামেরা ঝুলছে। এই দুদিন ওটা ওর সুটকে সেই বন্ধ ছিল। ফেলুদা আর লালমোহনবাবু দুজনেরই ইচ্ছে আজ কচৌরি গলিতে হনুমান হালুইকরের দাকানো গিয়ে রাবড়ি খাবে। আমারও যে ইচ্ছে সেটা বোধহয় না বললেও চলবে।
বিশ্বনাথের পাশেই কচৌরি গলি। এত বছর পরেও তার চেনা দোকানটা খুঁজে বার করতে ফেলুদার কোনও অসুবিধা হল না। দোকানের সামনে বেঞ্চি পাতা রয়েছে, তাতে বসে মাটির ভাঁড় থেকে রাবড়ি খেতে খেতে লালমোহনবাবু সবে বলেছেন।রাবাড়ির আবিষ্কারটা টেলিফোন-টেলিগ্ৰাফ আবিষ্কারের চেয়ে কীসে কম মশাই-এমন সময় কালকের সেই লোকটাকে দেখলাম বিশ-ত্রিশ হাত দূরে একটা দাকানের পাশে আমাদের দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে আরেকজন লোকের সঙ্গে কথা বলছে। মগনলালের ব্যাপারটা মাঝে মাঝে মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করি, ফেলুদা ওর কথা না মেনে একটা বেচাল চালালে কী সাংঘাতিক ব্যাপার হতে পারে সেটাও না-ভাবার চেষ্টা করি, কিন্তু ওই ঝোলা গোঁফওয়ালা লোকটা আবার সব মনে করিয়ে দিচ্ছে। যাই হাক, রাবাড়িটা এত বেশি ভাল যে মগনলালের চেহারাটা মনে পড়া সত্ত্বেও মুখের স্বাদ নষ্ট হল না।
ফেলুদার যা মনের অবস্থা তাতে ও যে খুব বেশিক্ষণ এই ঘিঞ্জি গলিতে থাকতে পারবে না সেটা আমি আগেই জানতাম। কচৌরি গলি থেকে বেরিয়ে মদনপুরা রোড ধরে গোধুলিয়ার মোড় ছাড়িয়ে আমরা বাঙালি-টালার দিকে হাঁটতে আরম্ভ করলাম। দুদিন ঘুরেই এদিকের রাস্তাগুলো বেশ চেনা হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে হাঁটছি, ফেলুদা এদিক ওদিক দেখছে, দু-একবার ক্যামেরার শাটারের শব্দও পেয়েছি। আমি মাঝে মাঝে পিছন ফিরে দেখছি সেই লোকটা এখনও আমাদের ফলো করছে কি না; কিন্তু বড় রাস্তায় পড়ে অবধি তার আর কোনও পাত্তা পাইনি। শেষটায় ফেলুদাকে বাধ্য হয়েই বলতে হয়, তোর কি ধারণা মগনলাল আমাদের উপর নজর রাখার জন্য মাত্র একটি লোক অ্যাপায়েন্ট করেছে?
এর পর আমি আর পিছনে তাকাইনি।
ওই যে সেই অ্যালুমিনিয়ামের বাসনের দোকান। ওর পরের বর্গ দিকের মোড়টা নিতে হয় অভয় চক্রবর্তীর বাড়ি যাবার জন্য।
মিস্টার মিত্তির! প্রদোষবাবু!
পিছন থেকে ডাক। তিনজনেই থামলাম। গলাটা অচেনা। দুটি ভদ্রলোক, বয়েস বেশি না-একজনের চোখে চশমা, মুখে হাসি। ইনিই বোধহয় ডেকেছিলেন।
আপনার হোটেলে গিয়েছিলাম খোঁজ করতে, ভদ্রলোক বললেন।
কী ব্যাপার? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
আমরা বেঙ্গলি ক্লাবের তরফ থেকে আসছি। আমার নাম সঞ্জয় রায়—ইনি গোকুল চ্যাটার্জি। ইয়ে-আপনাকে কিন্তু আসতে হবে। মানে আপনাদের তিনজনকেই।
কাবুলিওয়ালা?
আপনি জানেন? ভদ্রলোক দুজনই অবাক এবং খুশি।
আপনারা মিস্টার ঘোষালকে নেমন্তন্ন করতে গেসলেন না?
ওরে বাবা-আপনি দেখছি সবই জানেন, হেঃ হেঃ!
উনি তো জানবেনই, অন্য ভদ্রলোকটি সর্দি হওয়া গলায় হেসে বললেন। গোয়েন্দা হিসাবে ফেলুদার খ্যাতি বেঙ্গলি ক্লাব পৌঁছে গেছে।
আপনাদের কার্ডটা নিরঞ্জনবাবুর কাছে রেখে এসেছি। যাবেন কাইণ্ডলি। আমরা সবাই কিন্তু এক্সপেক্ট করে থাকব।
বেশ তো, অন্য কোনও জরুরি ব্যাপারে জড়িয়ে না পড়লে নিশ্চয়ই যাব।
জড়িয়ে মানে আপনি কি এখানেও কোনও—?
সঞ্জয় রায় আর গোকুল চ্যাটার্জির মাথা একসঙ্গে সামনের দিকে ঝুকে এল। ফেলুদা এরকম অবস্থায় পড়লে একটা হাসি ব্যবহার করে যেটার তিনরকম মানে হয়—হ্যাঁ, না, আর হতেও পারে। এখানেও তাই করল। হাসির মানেটা না বুঝলে বোকা হতে হয়, তাই সঞ্জয় রায় আর গোকুল চ্যাটার্জি দুজনেই বুঝে ফেলেছি। ভাবের একটা হাসি হেসে আবার কাবুলিওয়ালা দেখতে যাবার অনুরোধ জানিয়ে চলে গেলেন।
রাস্তা আর দোকানের বাতি সব জ্বলে গিয়েছে, আকাশের রং রয়েল ব্লু থেকে পামানেন্ট ব্লু ব্ল্যাকের দিকে যাচ্ছে, কীর্তিরাম ছোঁটুরামের পানের দোকানে এই মাত্র ট্রানজিস্টার খোলাতে লতা মঙ্গেশকর সাইকেল রিকশার প্যাঁক-প্যািকনির সঙ্গে পাল্লা দিতে শুরু করেছে, এমন সময় ফেলুদা অ্যানাউন্স করল যে তার ভক্তিভাব জেগেছে, একবার মছলিবাবার দর্শন না পেলেই নয়।
টেলিফোটো লেন্সে থ্রি পয়েন্ট ফাইভে হাফ সেকেন্ড একসপোজার দিয়ে ফেলুদা ভক্তদের পিছনে দাঁড়িয়ে আমার কাঁধে ক্যামেরা রেখে স্ট্যাচু হয়ে থাক বলে মছলিবাবার একটা ছবি তুলল। আজ ভক্তদের ভিড় সেদিনের চেয়েও বেশি।–বোধহয় বাবাজী পাঁচ দিন পরে চলে যাচ্ছেন বলে। মগনলালকে দেখলাম না। হয়তো এখনও আসেননি-কিংবা রোজ আসেন। না। আমরা মিনিট কয়েক থেকে আবার বেরিয়ে পড়লাম।
ডান দিকে মোড় নিয়ে একটা নতুন গলিতে এসে সামনে একটা কালো গোরুকে রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লালমোহনবাবু একটা ছোট্ট কাশি কেশে থেমে গেলেন।
কী হল? ফেলুদা প্রশ্ন করল।
ওটার হাইট কত হবে বলুন তো!
কেন
এথিনিয়াম ইনস্টিটিউশনে হাইজাম্পের রেকর্ড ছিল মশাই আমার। তারপর একবার ডেঙ্গু হয়ে বাঁ হাঁটুটা…
আসুন আমার সঙ্গে।
ফেলুদা এগিয়ে গিয়ে গোরুটার পাঁজরায় দু-তিনটে আলতো চাপড় দিতেই সেটা খুঁট খাট শব্দ করে একপাশে সরে গেল, আর আমরাও তিনজনে দিব্যি পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলাম।