লালমোহনবাবু পৌনে সাতটায় বিছানা ছেড়ে উঠে বললেন, স্বপ্ন দেখলুম। আমার সবঙ্গে ছারা বিঁধে রয়েছে, আর আমি সেইভাবেই রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজের আপিসে লেখার প্রুফ আনতে গিয়েছি, আর পাবলিশার হেমবাবু বলছেন।–আপনার ছদ্মনামটা চেঞ্জ করে জটায়ু থেকে শজারু করে দিন-দেখবেন বইয়ের কাটতি বেড়ে গেছে।
আমরা দুজনে যখন মুখটুখ ধুয়ে চা খাচ্ছি, তখন ফেলুদা বারান্দা থেকে ঘরে এসে বলল, লালমোহনবাবু, আপনার কোনও বইয়েতে ঘুড়ির সাহায্যে মেসেজ পাঠানোর কোনও ঘটনা আছে?
লালমোহনবাবু আক্ষেপের সঙ্গে মাথা নেড়ে বললেন, না মশাই, থাকলে তো খুশিই হতুমি। ওটা যদ্দূর মনে পড়ে নিশাচরের একটা বই থেকে নেওয়া। বোধহয় মানুষের রক্তমাংস?
নিশাচর কে?
ওটা ক্ষিতীশ চাকলাদারের ছদ্মনাম। রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজেরই আরেকজন লেখক। বলছি না—আপনাদের রুকুবাবাজী ওই সিরিজ একেবারে গুলে খেয়েছে।
আপশোস হচ্ছে! ফেলুদা খাটে বসে বলল—এতটা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা উচিত ছিল না। আপনাদের ওই সিরিজটাকে। ইয়ে—এক থেকে দশের মধ্যে একটা নম্বর বলুন তো।
সাত।
হঁ…। শতকরা সত্তর ভাগ লোক ওই নম্বরটা বলবে।
তাই বুঝি?
আর এক থেকে পাঁচের মধ্যে জিজ্ঞেস করলে বলবে তিন, আর ফুল জিজ্ঞেস করলে গোলাপ।
সাড়ে আটটার সময় হাটেলের চাকর হরকিষণ এসে খবর দিল ফেলুদার ফোন এসেছে। শুনে বেশ অবাক হলাম। কে ফোন করছে এই সকালবেলা? একবার ভাবলাম ফেলুদার সঙ্গে যাই নীচে, কিন্তু এক দিকের কথা শুনে বিশেষ কিছু বোঝা যাবে না বলে ধৈর্য ধরেই বসে রইলাম। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফেলুদা ফিরে এসে বলল, তেওয়ারি ফোন করেছিল। প্রয়াগ বা হরিদ্ধারে গত কয়েক মাসের মধ্যে কোনও নামকরা নতুন বাবাজীর আবিৰ্ভাব ঘটেনি। নো মছলিবাবা, নাথিং।
বোঝে! ইনি তা হলে ফোর-টুয়েন্টি? বললেন লালমোহনবাবু।
সেরকম তো অনেক বাবাজীই, লালমোহনবাবু; কাজেই তার জন্যে এঁকে আলাদা করে ভৎসনা করার কিছু নেই। এই প্রতারণার পিছনে আর কোনও গৃঢ় সিনস্টার অভিসন্ধি লুকিয়ে আছে কি না সেইটেই হচ্ছে প্রশ্ন।
আপনি কি জোড়া-তদন্তে জড়িয়ে পড়ছেন নাকি মশাই?
জোড়া কথাটার দুটো মানে হয় জানেন তো? জোড়া মানে ডবল আবার জোড়া মানে যুক্ত। এক্ষেত্রে জোড়া মানে যে কী সেটা এখনও ঠিক জানি না।
তেওয়ারি আর কিছু বললেন না?-আমি জিজ্ঞেস না করে পারলাম না। ফেলুদা প্ৰায় চার মিনিটের মতো টেলিফোনে কথা বলেছে, কিন্তু আমাদের এসে যেটা বলল তাতে এক মিনিটের বেশি লাগার কথা না।
ফেলুদা চিত হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে বলল, রায়বেরিলির জেল থেকে হুপ্ত তিনেক আগে এক জালিয়াত পালিয়েছে। এখনও নিখোঁজ। চেহারার বর্ণনা মছলিবাবার সঙ্গে খানিকটা মেলে, যদিও দাড়ি-গোঁফ নেই, আর এতটা কালো না।
তা সে তো মশাই মেক-আপের ব্যাপার, বললেন লালমোহনবাবু, একবার দিনের বেলা কাছ থেকে ভাল করে দেখে এলে হয় না? ঘাটে গিয়ে বসে থাকলেও তো হয়। বাবা ঘাটে যান নিশ্চয়ই।
সে গুড়ে বালি। শুধু সন্ধেয় দর্শন দেন, বাকি সময়টা দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরে বসে। থাকেন। সেখানে অভয় চক্কোত্তি ছাড়া আর কারও প্রবেশ নেই। খাওয়া-দাওয়া সব ওই। একই ঘরে।–আর নাওয়াটা মাইন্যাস।
আমরা দুজনেই অবাক। বাবাজী স্নান করেন না?
এ-সব তেওয়ারি বললেন?-লালমোহনবাবু প্রশ্ন করলেন।
এত কথা হল তোমার সঙ্গে?–আমি জুড়ে দিলাম।
ফেলুদা আমার দিকে চেয়ে ধীরে ধীরে তিনবার মাথা নেড়ে বলল, পর্যবেক্ষণ-পরীক্ষায় ফেল। তুই বাৱান্দায় গেলি আর লক্ষ করলি না যে আমার ভিজে পাঞ্জাবি আর পায়জামা দড়িতে ঝুলছে? ঘরে বসে কাপড় ভেজে শুনেছিস কখনও?
আমি চুন মুখে চুপ মেরে গেলাম।
ফেলুদা এবার যা বলল তা এই-ও চারটেয় উঠে সাড়ে চারটের আগে কেদারঘাটে পৌঁছে অভয় চক্রবর্তীর জন্য অপেক্ষা করে শেষটায় তার দেখা পেয়ে তার সঙ্গে আলাপ করে। —একেবারে মাটির মানুষ। না, মাটি ভুল হল; মোমের মানুষ। গলেই আছেন। আমাকেও গলার অভিনয় করতে হল। বুড়োমানুষের সঙ্গে ছিল করতে ভাল লাগছিল না, কিন্তু এ-সব ব্যাপারে গোয়েন্দার কিছুটা নির্মম না হলে চলে না। ওঁর কাছেই বাবাজীর হ্যাঁবিটস জানলাম। স্নান করেন না শুনে বোধহয় অজান্তে আমার নাকটা সিটিকে গোসল, তাতে বললেন–মনে যখন ময়লা নেই, তখন দশটা দিন গায়ে জল না ছোঁয়ালে ক্ষতি কী বাবা? জলেরই তো মানুষ, জল থেকেই তো উঠেছেন, আবার জলেই তো ফিরে যাবেন।–গায়ে অশিষ্টে গন্ধ কি না সেটা আর জিজ্ঞেস করলাম না। একটি চেলা নাকি রোজ সকালে আসে একবার করে-মাছের অংশ দিয়ে যায়, যেগুলো সন্ধেবেল বিলি হয়। অভয়বাবু ঘাট থেকে চলে যাবার পরও আমি কিছুক্ষণ ছিলাম। এক পাণ্ডা ওখানে ছাতার তলায় বসে, নাম লোকনাথ! সেদিনের ঘটনাটা দেখেছিল, যদিও গোড়ার দিকটা মিস করেছে। সে যখন এসেছে তখন বাবাজীর জ্ঞান হয়েছে। পাণ্ডাকে দেখে তার নাম ধরে ডেকে অনেক কিছু বলেছে। বাবাজী যদি ফোর-টুয়েন্টি হয়েও থাকেন, ওঁর যে একটি তুখোড় ম্যানেজার রয়েছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
তিনি অভয় চক্কোত্তি নন?
লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করলেন। না। অভয় চঙ্কোত্তি মশাই নিখাদ সর্জন ব্যক্তি; ওঁর মনে সংশয় ঢোকানোর চেষ্টা করেছিলাম। বললাম-প্ৰয়াগ থেকে সাঁতরে কাশী আসাটা প্ৰায় অবিশ্বাস্য নয় কি?–তাতে বললেন, সাধনায় কী না হয় বাবা।—এদের বিশ্বাসের জোরেই তো এই যান্ত্রিক যুগেও কাশী আজও কাশী। দেখবে চাঁদের মাটির নীচে মানুষের বসবাসের ব্যবস্থা হয়ে গেলেও কাশী কাশীই থেকে যাবে।