উঁহু, ফেলুদা বলল।শহর দেখে বেড়ালাম সারা দিন।
ওঁরা তো সব বেরিয়েছেন।
উমানাথবাবুর গাড়িটা দেখছিলাম না। তা ছাড়া বাড়িটা দেখেও কেমন জানি খালি খালি মনে হচ্ছিল।
কোথায় গেছেন? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
সারনাথ। আজও কিছু আত্মীয়স্বজন এসেছেন বাইরে থেকে। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া সেরে দুটো গাড়ি বোঝাই করে বেরিয়েছেন সব, ফিরতে সন্ধে হবে।
রুকুও গেছে?
না। রুকুর সারনাথ দেখা হয়ে গেছে। ও গেছে টারজান দেখতে ওর এক মামার সঙ্গে।
আসবার সময় রাস্তার দেওয়ালে বিজ্ঞাপন দেখেছি বটে। সেই আদ্যিকালের ছবি-আমার জন্মের আগে, ফেলুদার জন্মের আগে, এমন কী লালমোহনবাবুর জন্মের আগে–টারজন দি এপ ম্যান।
আমার ঘরে এসে বসবেন একটু? বিকাশবাবু প্রশ্ন করলেন।
ফেলুদা বলল, আগে একবার ছাদে যাব।—যদি সম্ভব হয়।
হ্যাঁ, হ্যাঁ–আপনার জন্য এ বাড়ির সব দরজা খোলা।
সামনের দরজা দিয়ে ঢুকেই চণ্ডীপাঠের আওয়াজ পেলাম। সেটা পুজোমণ্ডপ থেকে আসছে জানি, কিন্তু এত জোরে আওয়াজ তো কাল পাইনি। ডান দিকে চাইতেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। সিঁড়ির পিছনের দরজাটা আজ খোলা, আর সেটা দিয়ে দিব্যি পুজোর জায়গাটা দেখা যাচ্ছে। আমরা চারজনেই দরজাটার দিকে এগিয়ে গেলাম। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে শশীবাবু এক মনে তুলি চালিয়ে যাচ্ছেন।
কালই তো শশীবাবুর কাজ শেষ, বলল ফেলুদা।
হ্যাঁ, বললেন বিকাশবাবু, ভদ্রলোকের জুর এখনও সম্পূর্ণ সারেনি, তাও একনাগাড়ে তুলি চালিয়ে যাচ্ছেন।
ছাদ দেখা মানে যে আসলে রুকুর ঘর দেখা সেটা আগেই আন্দাজ করেছিলাম। সেদিন সকালে এ ঘরে রোদ ছিল না, আজ পশ্চিমের জানালা দিয়ে ঝলমলে রোদ এসে চারিদিকের ছড়ানো জিনিসের উপর পড়েছে।
আমি ভেবেছিলাম আজ যখন রুকু নেই তখন ফেলুদা হয়তো তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান চালাবে, কিন্তু তার পরেই মনে হল মগনলালের হুমকির কথা। বেশিক্ষণ শংকরী নিবাসে থাকাটাই ফেলুদার পক্ষে বিপজ্জনক। তা ছাড়া বেশি অনুসন্ধানের দরকার হল না, কারণ ফেলুদা যেটা খুঁজছিল সেটা ঘরে ঢুকেই পেয়ে গেল।
আজই বিকেলে সূরায্যের ফাঁসে বন্দি হতে দেখেছি। এই লাল-সাদা পেটকাটিটাকে। মেঝের উপর লাটাই চাপা অবস্থায় পড়ে আছে ঘুড়িটা; সেটার উপর যে উৎপাত হয়েছে। সেটা দেখলেই বোঝা যায়; কাল আর এ ঘুড়ি আকাশে উড়বে না।
ফেলুদা লাটাইটা তুলতেই একটা জিনিস চোখে পড়ল।
ঘুড়ির সাদা অংশটাতে নীল পেনসিল দিয়ে হিন্দি অক্ষরে কী যেন লেখা রয়েছে। দুটো জায়গায় আলাদা করে লেখা!
কাছ থেকে পড়ে বুঝতে পারলাম ভাষাটা বাংলা। বোধহয় সূরয বাংলা পড়তে পারে না বলেই রুকুকে এটা করতে হয়েছে।
একটা লেখা হল এই—
আমি বন্দি। সব ঠিক আছে। হা হা। আবার বিকেলে। ইতি ক্যাপ্টেন স্পার্ক।
অন্যটা হল–
টারজন দেখতে যাচ্ছি। আবার কাল সকালে। ইতি ক্যাপ্টেন স্পার্ক।
বাপরে বাপ। বলে উঠলেন লালমোহনবাবু। কোন জগতে বাস করে মশাই এ ছেলে?
ফেলুদা ঘুড়িটাকে আবার ঠিক যেইভাবে ছিল সেইভাবে রেখে বলল, রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজের জগৎ। শিশুমনের উপর আপনাদের বইয়ের কী প্রভাব তার স্পষ্ট নিদর্শন এটা।
আমরা রুকুর ঘর থেকে নীচে ফিরে এলাম। বিকাশবাবু চায়ের কথা আগেই বলে। দিয়েছিলেন, তার ঘরে গিয়ে বসতেই ভরদ্বাজ ট্রে নিয়ে ঢুকল।
ঘরটা বেশ বড়। একদিকে খাট, অন্যদিকে একটা কাজের টেবিলের সামনে একটা চেয়ার। এ ছাড়াও বসবার জন্য একটা সোফা রয়েছে। ফেলুদা টেবিলের সামনের চেয়ারটায় বসল, আমরা দুজন সোফাতে, আর বিকাশবাবু খাটে। পাশের বৈঠকখানায় ঘড়িতে মোলায়েম সুরে ঢং ঢেং করে চারটে বাজল; শুনলেই বোঝা যায় জাত ঘড়ি।মিস্টার ঘোষালের কেমিক্যালের ব্যবসা কীরকম চলে? ফেলুদা প্রশ্ন করল। ভালই তো। বিকাশবাবু যদি প্রশ্নটা শুনে অবাক হয়ে থাকেন তো সেটা তার কথায় কিছু বোঝা গেল না—অবিশ্যি মাঝে-মধ্যে যে স্ট্রাইক ইত্যাদি হয় না তা নয়। তা সে কোন ব্যবসায় হয় না বলুন!
হুঁ…
ফেলুদা হঠাৎ হাতের কাপটা রেখে উঠে পড়ে বলল, একবার বৈঠকখানাটা দেখতে পারি?
নিশ্চয়ই।
আমরা চারজনই চা খাওয়া বন্ধ রেখে বৈঠকখানায় গিয়ে হাজির হলাম। বিকাশবাবুর ঘর থেকে বৈঠকখানায় যাবার কোনও দরজা নেই; যেতে হলে আগে একটা বারান্দা পড়ে।
সেদিন মগনলাল আর উমানাথবাবু কোথায় বসেছিলেন সেটা জানতে পারি?
বিকাশবাবু দুটো মুখোমুখি সোফা দেখিয়ে দিলেন।
ওদিকে কি ঘর? না আরেকটা বারান্দা?
আমরা যে বারান্দা দিয়ে ঢুকলাম সেটা পূব দিকে; ফেলুদা দক্ষিণ দিকের দুটো পদৰ্থ দেওয়া দরজার দিকে দেখিয়ে প্রশ্নটা করল।
ওদিকে দুটো দরজার পিছনে দুটো ঘর। একটা বড় কতাঁর আপিস ঘর ছিল; অন্যটায় মক্কেলেরা অপেক্ষা করত।
আমরা দুটো ঘরের ভিতরেই ঢুকে মিনিটখানেক করে থেকে আবার বিকাশবাবুর ঘরে ফিরে এলাম। এবার ফেলুদা জিজ্ঞেস করল, গণেশটা কি কলকাতায় থাকত, না এখানে?
এখানে, বিকাশবাবু বললেন, ওটা যাওয়াতে মিস্টার ঘোষালের যত না কষ্ট হয়েছে, তার চেয়ে ঢের বেশি কষ্ট হয়েছে। ওঁর বাবার। ঔর মন ভাল করার জন্যই মিস্টার ঘোষাল এতটা ইয়ে হয়ে পড়েছেন।
ফেলুদা ইতিমধ্যে বিকাশবাবুর টেবিলের উপর থেকে ট্রানজিস্টারটা হাতে তুলে নিয়েছে। মাঝারি সাইজের মাফি রেডিয়ো, চামড়ার খোলস দিয়ে ঢাকা। ফেলুদা নবটা ধরে ঘোরাতে সুইচের কোনও আওয়াজ হল না। তারপর সেটা উলটা দিকে ঘোরাতে খটু করে একটা শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফেলুদার ভুরু কুঁচকে গেল।