মগনলাল সেইভাবেই চেয়ে আছে ফেলুদার দিকে। একটা ঘড়ির টিক্ টক্ শব্দ শুনতে পাচ্ছি, যদিও সেটা কোথায় আছে তা জানি না।
এবার মগনলালের ডান হাতটা আবার ফেলুদার দিকে এগিয়ে এল—ততে এখনও সেই নোটের তাড়া।
তিন হাজার আছে। এখানে মিস্টার মিত্তির। আপনি নিন এ টাকা। নিয়ে আপনি বিশ্রাম করুন, স্ফুর্তি করুন আপনার কাজিন আর আঙ্কলকে নিয়ে।
না মগনলালজী, ওভাবে আমি টাকা নিই না।
আপনি কাজ চালিয়ে যাবেন?
যেতেই হবে।
ভেরি গুড।
কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে মগনলালের হাত আবার কলিং বেলের উপর আছড়ে পড়ল। সেই লোকটা আবার দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মগনলাল লোকটার দিকে না তাকিয়ে বলল, অৰ্জ্জুনকো বোলাও-আউর তেরা নম্বর বুকস লাও-আউর তক্তা।
লোকটা চলে গেল! কী যে আনতে গেল তা ভগবান জানে।
মগনলাল এবার হাসি হাসি মুখ করে লালমোহনবাবুর দিকে চাইলেন। লালমোহনবাবুর ডান হাত এখনও সরবতের গেলাসটাকে ধরে আছে, যদিও সে গেলাস টেবিল থেকে এক ইঞ্চিও-ওঠেনি।
কেয়া মোহনভোগবাবু, আমার সরবত পসিন্দ হল না?
না না-বৎসর-ইয়ে, সরবত-মানে… আরও বললে আরও কথার গণ্ডগোল হয়ে যাবে। মনে করেই বোধহয় লালমোহনবাবু গেলাসটা তুলে ঢাক ঢক করে দু ঢোক সরবত খেয়ে ফেললেন।
আপনি ঘাবড়াবেন না মোহনবাবু-উ সরবতে বিষ নেই।
না না–
বিষ আমি খারাপ জিনিস বলে মনে করি।
নিশ্চয়ই–বিষ ইজ-আরেক ঢোক সরবত–ভেরি ব্যাড।
তার চেয়ে অন্য জিনিসে কাম দেয় বেশি।
অন্য জিনিস?
কী জিনিস সেটা এবার আপনাকে দেখাব।
খ্যাখ্!
কী হল মোহনভোগবাবু?
বিষ–মানে বিষম লাগল।
বাইরে পায়ের শব্দ।
একটা অদ্ভুত প্রাণী এসে ঘরে ঢুকল। সেটা মানুষ তো বটেই, কিন্তু এরকম মানুষ আমি কখনও দেখিনি। হাইটে পাঁচ ফুটের বেশি না, রোগী লিকলিকে শরীরের মাথা থেকে পা পর্যন্ত শিরা-উপশিরায় গিজগিজ করছে, মাথার চুলে কদম ছাঁট, কান দুটো খাড়া হয়ে বেরিয়ে আছে, চোখ দুটো দেখলে মনে হয় নেপালি, কিন্তু নিকটা খাঁড়ার মতো উঁচু আর খুঁচোলো। আরও একটা লক্ষ করার বিষয় এই যে, লোকটার সারা গায়ে একটাও লোমা নেই। হাত পা আর বুকের অনেকখানি এমনিতেই দেখা যাচ্ছে, কারণ লোকটা পরেছে একটা শতচ্ছিন্ন হাতকটা গেঞ্জি আর একটা বেগুনি রঙের ময়লা হাফ প্যান্ট।
লোকটা ঘরে ঢুকেই মগনলালের দিকে ফিরে একটা স্যালুট করল। তারপর হাতটা পাশে নামিয়ে কোমরটাকে একটু ভাঁজ করে সামনের দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রইল।
এবার ঘরে আরেকটা জিনিস ঢুকল। এটাই বোধহয় তেরো নম্বর বাক্স; দুটো লোক বাক্সটা বয়ে এনে গদির সামনে মেঝেতে রাখল। রাখার সময় একটা ঝনৎ শব্দে বুঝলাম ভিতরে লোহা বা পিতলের জিনিসপত্র আছে।
আরও দুটো লোক এবার একটা বেশ বড় কাঠের তক্তা নিয়ে এসে আমাদের পিছনের দরজাটা বন্ধ করে তার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল। এতক্ষণে মগনলাল আবার মুখ খুললেন।
নাইফ-থ্রোইং জানেন কী জিনিস মিস্টার মিত্তির? সাকাসে দেখেছেন কখনও?
দেখেছি।
সার্কাস আমি দেখেছি, কিন্তু নাইফ-গ্লোইং দেখিনি। ও-ই একবার বলেছিল ব্যাপারটা কীরকম হয়। একজন লোককে একটা খাড়া করা তক্তার সামনে দাঁড় করিয়ে দূর থেকে আরেকটা লোক তার দিকে একটার পর একটা ছোরা এমনভাবে মারতে থাকে যে, সেগুলো লোকটার গায়ে না লেগে তাকে ইঞ্চিখানেক বাঁচিয়ে তক্তার উপর গিয়ে বিঁধতে থাকে। সে নাকি এমন সাংঘাতিক খেলা যে দেখে লোম খাড়া হয়ে যায়। সেই খেলাই আজ দেখাবে নাকি এই অৰ্জ্জুন?
তেরো নম্বর বাক্স খোলা হয়েছে। ঘরে আরও দুটো বাতি জ্বলে উঠল। বাক্সে বোঝাই করা কেবল ছোরা আর ছোরা। সেগুলো সবকটা ঠিক একরকম দেখতে-সব কাঁটার হাতির দাঁতের হাতল, সব কটায় ঠিক একরকম নকশা করা।
হরবনসপুরের রাজার প্রাইভেট সার্কাস ছিল, সেই সাকাসেই অৰ্জ্জুন নাইফ থ্রোইং-এর খেল দেখাত। এখুন ও হামার প্রাইভেট সাকাসে খেল দেখায়–হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ…
বাক্স থেকে গুনে গুনে বারোটা ছোরা বার করে আমাদের সামনেই একটা শ্বেতপাথরের টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখা হয়েছে একটা খোলা জাপানি হাতপাখার মতো করে।
আসুন আঙ্কল।
আঙ্কল কথাটা শুনে লালমোহনবাবু তিনটে জিনিস একসঙ্গে করে ফেললেন—হাতের ঝাটকায় গেলাসের অর্ধেক সরবত মাটিতে ফেললেন, পেটে ঘুষি খাবার মতো করে সোজা থেকে সামনের দিকে ঝুকে গেলেন, আর অ্যাঁ বলতে গিয়ে গ্যাঁ বলে ফেললেন। পরে জিজ্ঞেস করাতে বলেছিলেন উনি নাকি অ্যাঁ আর গেলুম একসঙ্গে বলতে গিয়ে গ্যাঁ বলেছিলেন।
এবার ফেলুদার ইস্পাত-কঠিন গলার স্বর শোনা গেল।
ওকে ডাকছেন কেন?
মগনলালের হাসির চাটে তার কনুই আরও ইঞ্চি তিনেক তাকিয়ার ভিতর ঢুকে গেল।
ওকে ডাকব না তা কি আপনাকে ডাকব মিস্টার মিত্তির? আপনি তক্তার সামনে দাঁড়ালে খেল দেখবেন কী করে?…আপনি এ ব্যাপারে কিছু বলবেন না মিস্টার মিত্তির। আমার কথা বিসেয়াস না করে আপনি আমাকে অনেক অপমান করলেন। আপনি জানবেন। যে চাকু ছাড়াও অন্য হাতিয়ার আছে আমার কাছে। ওই ঘুলঘুলির দিকে দেখুন—দো ঘুলঘুলি, দো পিস্তল আপনার দিকে পয়েন্ট করা আছে। আপনি ঝামেলা না করেন তো আপনার কোনও ক্ষতি হবে না। আপনার বন্ধুর ভি কোনও ক্ষতি হবে না। অর্জনের জবাব নেই, আপনি দেখে নেবেন।
ঘুলঘুলির দিকে চাইবার সাহস আমার নেই। লালমোহনবাবুর দিকেও চাইতে ইচ্ছা! করছিল না, কিন্তু চাপা মিহি গলায় ওর একটা কথা শুনে না চেয়ে পারলাম না। ভদ্রলোক হাতল ধরে চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে কথাটা বলছেন, তার ফাঁকে ফাঁকে ওঁর হাঁটুতে হাঁটু লেগে খটখটি শব্দ হচ্ছে।