বাহরে বাঃ!-মগনলালোৱা পান-খাওয়া দাঁত আবার বেরিয়ে গেছে-আপনি পরিশ্রম করে কী করবেন? যেখানে চোরিই হল না, সেখানে আপনি চোর। পাকড়বেন কী করে মিস্টার মিত্তির?
চুরি হল না মানে?—এবারে ফেলুদাও অবাক—কোথায় গেল সে জিনিস?
সে জিনিস তো উমানাথ আমার কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। তিস হাজার ক্যাশ দিয়ে আমি সে জিনিস কিনে নিয়েছি।
কী বলছেন। আপনি উলটো-পালটা?
ফেলুদার বেপরোয় কথায় আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। সিলিং-এর বাতিটা থেকে একটা আলোর নকশা। লালমোহনবাবুর নাক আর ঠোঁটের উপর পড়েছে। বেশ বুঝলাম ওঁর ঠোঁট শুকিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
মগনলাল ওর শেষ কথাটা বলে হেসে উঠেছিল, ফেলুদা কথাটা বলতেই মনে হল একটা হাসির রেকর্ডের উপর থেকে কে যেন সাউন্ড-বক্সটা হঠাৎ তুলে নিল। মগনলালের মুখ এখন কালবৈশাখীর মেঘের মতো কালো, আর চোখ দুটো যেন কোিটর থেকে বেরিয়ে এসে বুলেটের মতো ফেলুদাকে বিঁধতে চাইছে।
উলটা-পালটা কে বলে জানেন? উলটা-পালটা বলে উলটো-পালটা আদমি। মগনলাল বলে না। উমানাথের বেপার কী জানেন। আপনি? তার বেওসার বিষয় কিছু জানেন? উমানাথের দেনা কত জানেন? উমা নিজে আমাকে ডেকে পাঠাল জানেন? উমা নিজে সিন্দুক থেকে গণপতি চারি করেছে জানেন? আপনি চোর কী ধরবেন মিস্টার মিত্তির-চোর তো আপনার মক্কেল নিজে!
ফেলুদা গভীর গলায় বলল, আপনি কী বলতে চাচ্ছেন সেটা পরিষ্কার হচ্ছে না মগনলালজী। নিজের জিনিস চুরি করবার দরকারটা কোথায়? সোজা সিন্দুক থেকে বার করে আপনার হাতে তুলে দিয়ে টাকাটা নিয়ে নিলেই তো হত।
কার সিন্দুক? সিন্দুক তো ওর বাবার।
কিন্তু গণেশটা তো—
গণেশ-কার? ঘোষাল ফ্যামিলির। ফ্যামিলি তিন জায়গায় ভাগ হয়ে গেছে। বড় ছেলে বিলাইতে ডাকটর–ছোট ছেলে উমানাথ কলকাতায় কেমিক্যালস–আর বাবা বেনারসের উকিল-এখুন প্র্যাক্টিস ছেড়ে দিয়েছেন। গণপতি ছিল অল অ্যালং বাবার কাছে। গণপতির ইনফ্লুয়েন্স দেখবেন তো ওনাকে দেখুন। কতো টাকা কামায়েছেন দেখুন, মেজাজ দেখুন, আরাম দেখুন। তার সিন্দুক থেকে গণেশ বার করে উমানাথ আমাকে বিক্রি করল—সে কথা সে বাপকে জানাবে কী করে? তার সাহস কোথায়?
ফেলুদা ভাবছে। সে কি মগনলালের কথা বিশ্বাস করছে?
সিন্দুক থেকে কবে গণেশ নিলেন উমানাথবাবু?
মগনলাল তাকিয়াটা আরও বুকের কাছে টেনে নিল।
শুনুন—অক্টোবর দশ তারিখ আমাকে ডেকে পাঠাল উমা। সেদিন কথা হল। আমি এগ্রি করলাম। আমার লাফ ভি কুছু খারাপ যাচ্ছে-আপনি হয়তো জানেন। লেকিন আমার টাকার অভাব এখুনো হয়নি। আর উ গ্রিন ডায়মন্ডকে কত দাম জানেন? উমা জানে না! আমি যা পেশ করলাম। তার চেয়ে অনেক বেশি। এনিওয়ে-দশ অক্টোবর কথা হল। উমা বলল আমাকে দো-তিন দিন টাইম দাও। আমি বললাম নাও! ফিফটিনৰ্থ অক্টোবর ইভনিং উমা আবার ফোন করল। বলল। গণেশ আমার হাথে এসে গেছে। আমি বললাম। তুমি চলে এসো মছলিবাবা দৰ্শন করতে। উমা এসে গেল! আমি এসে গেলাম। আমার হাথে ব্যাগ, উর। পাকিটে ব্যাগ। উর ব্যাগে গণপতি, আমার ব্যাগে তিন-সিও হাভূড রুপি নোটস। দর্শন ভি হল, ব্যাগ বদল ভি হল। ব্যস, খতম।
মগনলাল যদি সত্যি কথা বলে থাকে, তা হলে বলতে হবে উমানাথবাবু আমাদের সাংঘাতিক ভাঁওতা দিয়েছেন আর নিজের মান বাঁচানার জন্য একটা চুরির গল্প খাড়া করে ফেলুদাকে তদন্তু চালাতে বলেছেন। অবশ্যি সেই সঙ্গে পুলিশকেও ভাঁওতা দিয়েছেন। পুরো ব্যাপারটাই ফেলুদার পক্ষে পণ্ডশ্রম হবে, আর পকেটে পয়সাও আসবে না। কিন্তু মগনলালই বা ফেলুদার প্রতি এত সদয় হবে কেন?
আমি প্রায় চমকে উঠলাম যখন ফেলুদা ঠিক এই প্রশ্নটাই মগনলালকে করে বসল। মগনলাল তার চোখ দুটোকে আরও ছোট করে একটু সোজা হয়ে বসে বলল, কারণ আমি জানি আপনি বুদ্ধিমান লোক। অর্ডিনারি বুদ্ধি না, একস্ট্রা-অর্ডিনারি বুদ্ধি। আপনি আরও কিছুদিন তদন্ত করলে যদি আসল বেপারটা বুঝে ফেলেন, তখন উমরাও মুশকিল, আমারও মুশকিল। আমাদের এই লেনদেনের বেপারটা তো ঠিক সিধা-সাফা নয়-সে তো আপনি বুঝেন মিস্টার মিত্তির।
ফেলুদা চুপ করে আছে। তিন গেলাস সবুজ রঙের সরবত এসেছে—আমাদের সামনে টেবিলের উপর রাখা। ফেলুদা একটা গেলাস হাতে তুলে নিয়ে বলল, গণেশটা তা হলে আপনার কাছেই আছে। সেটা একবার দেখা যায় কি? যেটার সঙ্গে এত রকম ইতিহাস জড়িত, সেটা একবার দেখতে ইচ্ছা হওয়াটা স্বাভাবিক এটা আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন।
মগনলাল মাথা নেড়ে বললেন, ভেরি সরি মিস্টার মিত্তির, আপনি তো জানেন আমার এ বাড়িতে একবার রেড হয়ে গেছে। ও জিনিস কী করে আমি এখানে রাখি বলুন। ওটা আমাকে একটা সেফ জায়গায় পাঠিয়ে দিতে হয়েছে।
ফেলুদার পরের কথাতে ওর বেপরোয়া ভাবটা আমার কাছে আবার নতুন করে ফুটে বেরোল।
তা পাঠিয়েছেন বেশ করেছেন, কিন্তু আপনি সত্যি বলছেন কি না জানার জন্যও তো আমাকে অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে হবে মগনলালজী।—তাতে যদি আপনার কথা সত্যি বলে প্রমাণিত হয় তা হলে তো কথাই নেই, কিন্তু ধরুন যদি তা না হয়?
মগনলালের তলার ঠোঁটটা বিশ্ৰীভাবে নীচের দিকে ঝুলে পড়ল, আর তার ভুরুজোড়া আরও নেমে এসে চোখ দুটোকে অন্ধকারে ঠেলে দিল।
আপনি আমার কথা বিসোয়াস করছেন না?
লালমোহনবাবু সরবতের গেলাসটা তুলেই আবার ঠিক করে নামিয়ে রাখলেন। ফেলুদার হাতের গেলাস আস্তে আস্তে ঠোঁটের কাছে চলে গেল। সরবতে একটা চুমুক দিয়ে একদৃষ্টি মগনলালের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি নিজেই বললেন আপনাকে আমি চিনি, না। কী করে আশা করেন প্রথম আলাপেই আমি আপনার সব কথা বিশ্বাস করব? আপনি নিজেই কি সব সময় নতুন লোকের কথা বিশ্বাস করেন–বিশেষ করে যখন সে লোক দিনকে রাত করে দেয়?