একটা ঘর, তারপর একটা সরু প্যাসেজ, আর তারপর আরেকটা ঘর পেরিয়ে একটা অন্ধকার বারান্দা দিয়ে বেশ খানিকদূর গিয়ে একটা নিচু দরজা পড়ল। লোকটা এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে ফিরে ডান হাত বাড়িয়ে দরজার ভিতর যাবার জন্য ইশারা করল। কথা না বললেও লোকটার মুখ থেকে বিডির কড়া গন্ধ পাচ্ছিলাম।
যে ঘরটায় ঢুকলাম সেটা যে কত বড় সেটা তক্ষুনি বোঝা গেল না, কারণ প্রথমে ঢুকে কয়েকটা রঙিন কাচ ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না। বুঝলাম কাচগুলো জানালায় লাগানো বলে তাতে বাইরের আলো পড়েছে।
নোমোস্কার মিস্টার মিটার।
খসখসে সুগভীর দানাদার গলাটা আমাদের সামনে থেকেই এসেছে। এবারে চোখ অন্ধকারে সয়ে এসেছে। একটা সাদা গদি দেখতে পাচ্ছি—আমাদের সামনে কিছুটা দূরে মেঝেতে বিছানো রয়েছে। তার উপরে চারটে সাদা তাকিয়া। একটায় ভর দিয়ে আড় হয়ে বসে আছে একটা লোক, যার শুধু পিছন দিকটা আমরা সেদিন দেখেছি। মছলিবাবার ভক্তদের মধ্যে।
একটা খুটি শব্দের সঙ্গে সিলিং-এ একটা বাতি জ্বলে উঠল। পিতলের বলের গায়ে ফুটা ফুটা জফ্রির কাজ-সেটা হল বাতিটার শেড। ঘরের চারদিক এখন বুটিদার আলোর নকশায় ভরে গেছে।
এখন সব কিছু দেখতে পাচ্ছি। মগনলাল মেঘরাজের ভুরুর নীচে গর্তে বসা চোখ, তার নীচে ছোট্ট থ্যাবড়া নাক, আর তার নীচে এক জোড়া ঠোঁট, যার উপরেরটা পাতলা আর নীচেরটা পুরু। ঠোঁটের নীচে থুতনিটা সোজা নেমে এসেছে একেবারে আদ্দির পাঞ্জাবির গলা অবধি। পাঞ্জাবির বোতামগুলো হিরের হলে আশ্চর্য হব না। এ ছাড়া ঝলমলে পাথর আছে দশটা আঙুলের আটটা আংটিতে, যেগুলো এখন নমস্কারের ভঙ্গিতে এক জায়গায় জড়ো হয়ে আছে। r
বোসুন আপনারা। দাঁড়িয়ে কেনো?
দিব্যি বাংলা।
চাই তো গদিতে বসুন। আর নয়তো চেয়ার আছে। যাতে ইচ্ছা বসুন।
চেয়ারগুলো নিচু। পরে ফেলুদা বলেছিল। ওগুলো নাকি গুজরাটের। আমরা গদিতে না বসে চেয়ারেই বসলাম-ফেলুদা একটাতে আর আমি আর লালমোহনবাবু আরেকটাতে।
মগনলাল সেইভাবেই কত হয়ে থেকে বললেন, আপনার সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছা ছিল, ভাবছিলাম আপনাকে ইনভাইট করে নিয়ে আসব। ভগওয়ানের কৃপায় আপনি নিজেই এসে গেলেন। তারপর একটু হেসে বললেন, আপনি আমাকে চিনেন না, কিন্তু হামি আপনাকে চিনি।
আপনার নামও আমি শুনেছি, ফেলুদা পালটা ভদ্রতা করে বলল।
নাম বলছেন কেন, বদনাম বলুন। সত্যি কথা বলুন!
মগনলাল কথাটা বলে হা হা করে হেসে উঠলেন, আর তার ফলে তাঁর পানখাওয়া দাঁতগুলোতে আলো পড়ে চকচক করে উঠল। ফেলুদা চুপ করে রইল। মগনলালের মাথাটা আমার দিকে ঘুরে গেল।
ইনি আপনার ব্রাদার?
কাজিন।
আর ইনি? আঙ্কল?
মগনলালের চোখে হাসি, চোখ ঘুরে গেছে জটায়ুর দিকে।
ইনি আমার বন্ধু। লালমোহন গাঙ্গুলী।
ভেরি গুড। লালমোহন, মোহনলাল, মগনলাল-সব লাল, লালে। লাল–এঁ? কী বলেন?
লালমোহনবাবু কিছুক্ষণ থেকে হাঁটু নাচিয়ে আমি একটুও নাভার্স হইনি, ভাব দেখানার চেষ্টা করছিলেন, এবার মগনলালের কথাটা শুনেই হাঁটু দুটো খট খট শব্দ করে পরস্পরের সঙ্গে লাগিয়ে নাচানো বন্ধ হয়ে গেল।
এবার মগনলালের বাঁ হাতটা একটা থাপ্নড়ের ভঙ্গিতে তাকিয়ার পিছনে নামাতেই ঠং করে একটা কলিং বেল বেজে উঠে। লালমোহনবাবুকে বিষম খাইয়ে দিল।
গলা সুখিয়ে গেলো? বললেন মগনলাল।
বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখি যো-লোকটা আমাদের উপরে নিয়ে এসেছিল সে আবার দরজার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।
সরবত লাও, হুকুম করলেন মগনলাল।
এখন ঘরের সব জিনিসই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। মগনলালের পিছনের দেওয়ালে দেবদেবীর ছবির গ্যালারি। ডান দিকে দেওয়ালের সামনে দুটো স্টিলের আলমারি। গদির উপরে কিছু খাতপত্র, একটা বোধহয় ক্যাশবাক্স, একটা লাল রঙের টেলিফোন, একটা হিন্দি খবরের কাগজ! এ ছাড়া তাকিয়ার ঠিক পাশেই রয়েছে একটা রুপের পানের ডিবে। আর একটা রুপোর পিকদান।
ওয়েল মিস্টার মিত্তির—মগনলালের স্থির দৃষ্টিতে আর হাসির নামগন্ধ নেই—আপনি বনারস হলিডের জন্যে এসেছেন?
সেটাই মূল উদ্দেশ্য ছিল।
ফেলুদা সটান মগনলালের চোখের দিকে চেয়ে কথা বলছে।
তা হলো–আপনি–টাইম–ওয়েস্ট—করছেন–কেন?
প্রত্যেকটা কথা ফাঁক ফাঁক আর স্পষ্ট করে বলা।
সারনাথ দেখেছেন? রামনগর দেখেছেন? দুর্গাবাড়ি, মানমন্দির, হিন্দু ইউনিভার্সিটি, বেণীমাধোব ধ্বজ–এ-সব কিছুই দেখলেন না, আজ বিশ্বনাথজীর দরওয়াজার সামনে গেলেন, কিন্তু ভিতরে ঢুকলেন না, কচৌরি গলিতে মিঠাই খেলেন না…ঘোষালবাড়িতে কী কাম আপনার? আমার বজরা আছে আপনি জানেন? চৈতি ঘটসে অসসি ঘাট টিরিপ দিয়ে দেবো আপনাকে, আপনি চলে আসুন। গঙ্গার হাওয়া খেয়ে আপনার মনমেজাজ খুশী হয়ে যাবে।
আপনি ভুলে যাচ্ছেন-ফেলুদার গলা এখনও স্থির, যাকে বলে নিষ্কম্প–যে আমি একজন পেশাদারি গোয়েন্দা। মিস্টার ঘোষাল আমাকে একটা কাজের ভার দিয়েছেন। সে কাজটা শেষ না করে ফুর্তি করার কোনও প্রশ্ন আসে না।
কতো আপনার ফ্রি?
ফেলুদা প্রশ্নটা শুনে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল। তারপর বলল, দ্যাট ডিপেন্ডস—
এই নিন।
তাজ্জব, দম-বন্ধ-করা ব্যাপার। মগনলাল ক্যাশবাক্স খুলে তার থেকে একতাড়া একশো টাকার নোট বার করে ফেলুদার দিকে এগিয়ে দিয়েছে।
ফেলুদার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।
বিনা পরিশ্রমে আমি পারিশ্রমিক নিই না মিস্টার মেঘরাজ।