ভেরি গুড। এটা করতে কোনও অসুবিধা নেই। আমি দু দিনের মধ্যে আপনাকে ইনফরমেশন এনে দেব।
দারোগাসাহেব ঘড়ি দেখে উঠে পড়লেন। দরজার মুখে ভদ্রলোক ফেলুদার পিঠ চাপড়ে বললেন, এক’দিন চৌকে আমাদের থানায় আসুন না। কী রকম কাজ হচ্ছে দেখে যান। আর—, তেওয়ারি গভীর-আমি আপনাকে সিরিয়াসলি বলছি-আপনি যত ইচ্ছে হলিডে করুন, কিন্তু এ বেপারে জড়াবেন না।
দুপুরের ডাল ভাত কপির তরকারি মাছের ঝোল আঁর দইয়ের সঙ্গে জিলিপি খেয়ে আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে পান। কিনলাম। লালমোহনবাবুকে এমনিতে কখনও পান খেতে দেখিনি; এখানে দেখলাম সাত রকম মশলা দেওয়া রুপোর তত্ত্বক দিয়ে মোড়া একটা প্ৰকাণ্ড পান চার আঙুল দিয়ে ঠেলে মুখের ভিতর পুরে দিব্যি চিবোতে লাগলেন। আমরা কোনও বিশেষ জায়গায় যাব বলে বেরিয়েছি কি না জানি না, কারণ ফেলুদা কিছু বলেনি। লালমোহনবাবু একবার আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন, তোমার দাদা বোধহয় সেই হালুইকরের দোকানে গিয়ে রাবাড়ি খাবেন। আমার ধারণা। কিন্তু অন্য রকম-যদিও সেটা আমি মুখে প্রকাশ করলাম না! ফেলুদাকে অনুসরণ করে আমরা হাটেলের উলটা দিকে একটা গলিতে ঢুকে এগিয়ে চললাম।
একটু এগিয়ে বুঝতে পারলাম। এদিকটায় বাঙালির নামগন্ধ নেই। লালমোহনবাবু চান্দরটিকে ভাল করে জড়িয়ে নিয়ে বললেন, আপনি চোখ, কান আর নাকের কথা বললেন, কিন্তু টেমপারেচারের কথা তো বললেন না। এদিকটায় বেশ শীত শীত লাগছে মশাই।
দুদিকে তিন তলা চার তলা বাড়ি উঠে গেছে, আর তার মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে চলেছে। গলি। সূর্যের আলো প্রায় পৌঁছায় না বললেই চলে। ফেলুদা বলল, বেনারসের গলির বেশির ভাগ বাড়িই নাকি দেড়শো থেকে দুশো বছরের পুরনো। রাস্তার দু দিকের দেওয়ালে যেখানে সেখানে ছবি আঁকা-হাতি, ঘোড়া, বাঘ, টিয়া, ঘোড়সওয়ার; কারা কখন ঐকেছে। জানি না, কিন্তু দেখতে বেশ লাগে? মাঝে মাঝে এক-একটা হাতে-লেখা হিন্দি বিজ্ঞাপন-তার মধ্যে নওজোয়ান বিড়ি সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে।
এতক্ষণ চারিদিকে বেশ চুপচাপ ছিল— এবার ক্রমে ক্ৰমে ক্যানে নানারকম নতুন শব্দ আসতে আরম্ভ করল। তার মধ্যে সব ছাপিয়ে উঠছে ঘণ্টার শব্দ। ঘণ্টার ফাঁকগুলো ভরিয়ে রেখেছে যে শব্দটা তাকেই বলা হয় কোলাহল। ফেলুদা বলে এই কোলাহল জিনিসটা খুব মজার। হাজার লোক এক জায়গায় রয়েছে, সবাই নিজেদের মধ্যে সাধারণভাবে কথাবার্তা বলছে, কেউ গলা তুলছে না, অথচ সব মিলিয়ে যে শব্দটা হচ্ছে তাতে কান ফেটে যাবার জোগাড়।
এরই মধ্যে বেশ কয়েকটা ষাঁড় আমাদের সামনে পড়েছে, আর প্রতিবারই লালমোহনবাবু বলে উঠেছেন, ওই দেখুন, মেঘরাম? শেষটায় ফেলুদা বলতে বাধ্য হল যে তার ধারণা মেঘরাজের চেয়ে ষাঁড় জিনিসটা অনেক বেশি নিরীহ এবং নিরাপদ। —আমি মশাই একজন ডাকসাইটে প্রতিদ্বন্দ্বী কল্পনা করে মনে উৎসাহ আনার চেষ্টা করছি, আর আপনি বার বার ষাঁড়ের সঙ্গে তুলনা করে তাকে খাটা করছেন।
চোখ, কান আর নাককে একসঙ্গে আক্রমণ করতে বিশ্বনাথের গলির মতো আর কিছু আছে কি না জানি না। এখানে এসে আর নিজের ইচ্ছেমতো হাঁটা যায় না; ভিড় যে দিকে নিয়ে যায়। সেই দিকে যেতে হয়। আমরাও এগিয়ে চললাম ভিড়ের সঙ্গে! দর্শন হবে বাবু? বাবু বিশ্বনাথ দৰ্শন হবে? পাণ্ডার চারিদিক থেকে ছেকে ধরেছে। ফেলুদা নির্বিকার। আমরা তিনজনেই তাদের কথায় কান না দিয়ে যদ্দূর পারি ধাক্কা বাঁচিয়ে পকেট বাঁচিয়ে রাস্তার পিছল জায়গাগুলো বাঁচিয়ে এগিয়ে চললাম। লালমোহনবাবুর মনে যতই ভক্তিভাব জাগুক না কেন, ওঁর চোখ কিন্তু চলে গেছে। মন্দিরের সোনায় মোড়া চুড়োর দিকে। একবার ফেলুদাকে কী যেন প্রশ্নও করলেন চুড়োর দিকে আঙুল দেখিয়ে। গোলমালে কী বললেন শুনতে পেলাম না, তবে ক্যারেট কথাটা কানে এল। চুড়ের দিকে চাইতে গিয়েই চোখে পড়ল আকাশে দশ-বারোটা চিল চক্কর দিচ্ছে, আর তারই এক পাশে একটা লাল-সাদা পেটকাঢ়ি ঘুড়ি গোঁৎ খেয়ে মন্দিরের পিছনে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ফেলুদাও ঘুড়িটাকে দেখেছে।
আমরা দুজন ফেলুদারই পিছন পিছন আরও খানিকটা এগিয়ে গেলাম-যদি আবার ঘুড়িটাকে দেখা যায়। হ্যাঁ-ওই তো আবার দেখা যাচ্ছে-লাল-সাদা পেটকাটি। ওই তো উপর দিকে উঠল, আর ওই তো আবার গোঁৎ খেয়ে নীচের দিকে নেমে একটা চারতলা বাড়ির পিছনে অদৃশ্য হয়ে গেল।
মোস্ট ইন্টারেস্টিং…
চাপা গলায় বললেও, ফেলুদার ঠিক পাশেই থাকায় ওর কথাটা আমি শুনতে পেলাম।
লালমোহনবাবু বললেন, শুধু ইন্টারেস্টিং কেন বলছেন মশাই—আমার কাছে তো ডিস্টাবিং বলেও মনে হচ্ছে। মানে, ঘুড়িটার কথা বলছি না। চারদিকে এত দাড়ি আর জটার মধ্যে মেঘরামের কত স্পাই ঘোরাফেরা করছে ভাবতে পারেন? একটি লোক তো আপনার দিক থেকে চোখ ফেরাচ্ছে না। আমি আড়াচোখে ওয়াচ করে যাচ্ছি। প্রায় তিন মিনিট ধরে।
ফেলুদা আকাশের দিক থেকে চোখ না নামিয়েই বলল, গোঁফ-দাড়ি-জটা-ব্যষ্টি-কমাণ্ডুল, আর গায়ে টাটকা নতুন-কেনা হিন্দি নামাবলী তো?
ফুল মার্কস, বললেন জটায়ু।
আমরা আবার এগিয়ে গেলাম। সামনেই একটা ষাঁড়ের পিছনে একটা সিঁদুর আর জবাফুলে বোঝাই দোকানের পাশে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। ফেলুদা তার সামনে এসে বেশ জোর গলায় বলল, জয় বাবা বিশ্বনাথ! আমার হাসি পেলেও একদম চেপে গেলাম।