ক্যালকাটা লজে ঢুকে সামনেই আপিসঘর। ম্যানেজারের চেয়ার ছাড়া আরও তিনটে চেয়ার আর একটা বেঞ্চি আছে। সেগুলোতে দু-তিনজন করে নিরঞ্জনবাবুর আলাপী লোক প্রায় সব সময়ই বসে আড্ডা মারে। আজ ঢুকে দেখলাম নিরঞ্জনবাবুর উলটা দিকে একজন প্যান্ট-শার্ট পরা বেশ জোয়ান লোক বসে চা খাচ্ছেন, আর হাত নেড়ে নিরঞ্জনবাবুকে কী যেন বোঝাচ্ছেন। আমাদের ঢুকতে দেখেই ম্যানেজারমশাই পানীমুখে একগাল হেসে বললেন, এই তো–ইনি আপনার জন্য প্রায় কুড়ি মিনিট বসে। আলাপ করিয়ে দিই–সাব-ইনস্পেক্টর। তেওয়ারি–আর ইনি–
নিরঞ্জনবাবু পর পর আমাদের তিনজনের নাম বলে বললেন, ভয় নেই–হিন্দি বলতে হবে না–ইনি দিব্যি বাংলা বলেন।
তেওয়ারি ফেলুদার দিকে একদৃষ্টি চেয়ে আছেন। চোখের কোণে হাসি এই এল বলে, আর ফেলুদার চোখে ভ্রূকুটি, সেটাও মনে হচ্ছে একটা হাসির অপেক্ষায় রয়েছে।
সে কী মশাই–ফেলুদার ভ্রূকুটি হাওয়া—আপনি এলাহাবাদে ছিলেন না?
দারোগাসাহেব ঝকঝকে দাঁত বার করে হেসে ফেলুদার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, আমি শিওর ছিলাম না। আপনি চিনবেন কি না।
চেনা মুশকিল। গোঁফটা যা ছিল তার চার ভাগের এক ভাগ হয়ে গেছে। রোগাও হয়েছেন বেশ খানিকটা।
ভদ্রলোক ফেলুদার সমান লম্বা আর গড়নেও ফেলুদারই মতো ছিমছাম। বছর দু-এক আগে এলাহাবাদে ফেলুদার একটা কেস পড়েছিল। পুলিশ প্যাচে পড়ে গিয়েছিল, কিন্তু ফেলুদা দু-দিনের মধ্যে সমস্যার সমাধান করে দিয়ে চার দিনের ভিতর কলকাতায় ফিরে এসেছিল। বুঝলাম সেইবারই তেওয়ারির সঙ্গে আলাপ হয়।
আমি মিস্টার ঘোষালের কাছে গিয়েছিলাম কাল রাত্রে আপনি চলে আসার পর। তখনই শুনলাম। আপনি এসেছেন। আর ক্যালকাটা লজে আছেন।
নিরঞ্জনবাবু চায়ের অর্ডার দিয়েছেন, আমরা তিনজনে বসলাম! ফেলুদা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, যাক!—মিস্টার ঘোষাল পুলিশের কথা বলতে আমার একটু দুশ্চিন্তা যাচ্ছিল; এখন আপনাকে দেখে অনেকটা হালকা লাগছে। আপনার সঙ্গে ক্ল্যাশ হবে না; আর মনে হয় দুটো মাথা এক করলে বোধহয় কাজের সুবিধেই হবে। বেশ গোলমেলে ব্যাপার—তাই না মশাই?
তেওয়ারি একটা শুকনো হাসি হেসে বললেন, ইন ফ্যাক্ট ইট ইজ সো গোলমেলে যে আমি তো আপনাকে এলাম বারণ করতে।
কেন বলুন তো?
মগনলাল যে বেপারে আছে, সে বেপারে এই হচ্ছে আমার অ্যাডভাইস। আপনি দুদিন গেলেন মিস্টার ঘোষালের বাড়ি, তার জন্য আমার খুব ভাওনা হচ্ছে। আপনাকে খুব সাওধান থাকতে হবে। ওর স্পাই আর ভাড়াটে গুণ্ডা সারা বেনারস শহরে ছড়িয়ে আছে।
হরকিষণ চা নিয়ে এল। ফেলুদা চিন্তিতভাবে একটা কাপ তুলে নিয়ে বলল, কিন্তু মগনলাল যে এ ব্যাপারে সত্যিই জড়িত সে সম্বন্ধে আপনি এত নিশ্চিত হচ্ছেন কী করে?
মিস্টার তেওয়ারি ভুরুটা কুঁচকে বা হাতের আঙুলগুলো দিয়ে টেবিলের উপর কয়েকটা টোকা মেরে বললেন, আমরা যে লাইনে ইনভেস্টিগেশন করছি, তাতে মগনলালকে একেবারে বাদ দেওয়া যায় না। ওর মতো কানিং লোক আর নেই।
আপনারা কোন লাইনে তদন্ত চালাচ্ছেন সেটা…
বলছি আপনাকে। আপনার কাছে আমি কিছুই লুকাব না। ঘোষালবাড়ির সবাইয়ের সঙ্গে আপনার আলাপ হয়েছে কি?
চাকর-বাকির বাদে আর মোটামুটি সকলের সঙ্গেই হয়েছে।
শিশীবাবুকে দেখেছেন তো?
হ্যাঁ, দেখেছি বই কী। আজই সকলে তার সঙ্গে কথা হয়েছে।
ওর ছেলেটিকে দেখেছেন নিশ্চয়ই।
হ্যাঁ-সেও তো কাজ করছিল।
কিন্তু শশীবাবুর আরেকটি ছেলে আছে সেটা জানেন?
এ খবরটা অবিশ্যি আমরা কেউই জানতাম না! এ ছেলেটির নাম নিতাই। ভেরি ব্যান্ড টাইপ। আঠারো বছর বয়েস, আর এ বয়সে যত খারাপ দোষ থাকতে পারে, সবই আছে। আমরা এখনও কোনও প্রমাণ পাইনি, কিন্তু ধরুন, যদি সে মগনলালের খপ্পরে পড়ে থাকে-
ফেলুদা হাত তুলে বলল, বুঝেছি। মগনলাল নিতাইকে হাত করবে, নিতাই হয় তার বাপকে না হয় দাদাকে হুমকি দিয়ে তাদের সিন্দুক খুলিয়ে গণেশ চুরি করবে।
এগজ্যাক্টলি, বললেন মিস্টার তেওয়ারি। নিতাইয়ের ব্যাপারটা জানার পর থেকেই মনে হচ্ছে একটা রাস্তা পাওয়া গেছে। আমার অ্যাডভাইস আপনি এখন চুপচাপ থাকুন। দসেরা টাইমে বেনারসে অনেক কিছু দেখবার আছে–সেই সব দেখুন, কিন্তু ঘোষালবাড়িতে বেশি। যাতায়তা করবেন না।
ফেলুদা অল্প হেসে চায়ে চুমুক দিয়ে একেবারে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল।
আপনারা মছলিবাবা সম্বন্ধে কোনও তদন্ত করার প্রয়োজন বোধ করছেন না?
তেওয়ারি হাতের কাপটা টেবিলের উপর রেখে একটা প্ৰাণখোলা হাসি হেসে বলল, আপনাদের এর ভিতরেই মছলিবাবা দৰ্শন হয়ে গেছে? কী মনে হল?
তদন্তের কথা যখন তুললাম, তখন খুব যে একটা ভক্তি জাগেনি মনে সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।
সে তো আপনার কথা হল, কিন্তু আপনি তার ভক্তদের দেখেছেন? আপনি ইনভেস্টিগেশনের কথা বলছেন—খোলাখুলি ভাবে কিছু করতে গেলে ভক্তরা আমাদের আস্ত রাখবে?
কথাটা বলে মিস্টার তেওয়ারি আড়াচোখে নিরঞ্জনবাবুর দিকে চাইতে ভদ্রলোক হাত তুলে বলে উঠলেন, আমার দিকে কী দেখছেন মশাই! আমাদের ভক্তি মানে কী? ভক্তিটক্তি কিচ্ছু না—মছলিবাবা হলেন আমাদের ছকে ফেলা একঘেয়ে জীবনে সামান্য একটু ব্যতিক্রমের ছিটেফোঁটা-ব্যাস।
ফেলুদা বলল, একটা জিনিস আপনি করতে পারেন মিস্টার তেওয়ারি-হরিদ্বার আর এলাহাবাদে খবর নিয়ে দেখতে পারেন। সেখানে গত মাসখানেকের মধ্যে মছলিবাবা নামে কোনও সিদ্ধপুরুষের আবিভব ঘটেছিল কি না।