আজ্ঞে পরশুই তো ষষ্ঠী! কাল রাত্তিরের ভেতরই হয়ে যাবে। বয়স হয়ে গেল তো, তাই কাজটা একটু ধরে করতে হয়।
তাও আপনার তুলির টানে এখনও দিব্যি জোর আছে।
আজ্ঞে এ কথা। আপনি বলছেন, আর, আরবছর এই দুগ্ধঠাকুর দেখেই ওই একই কথা বলেছিলেন কলকাতার আর্ট ইস্কুলের একজন শিক্ষক। এ জিনিসের কদর আর কে করে বলুন! সবাই ঠাকুরই দেখে, হাতের কাজটা আর কজন দেখে।
বিকাশবাবু যেদিন আপনাকে ওষুধ দেন, সেদিনই সন্ধ্যায় বাড়ির দোতলার সিন্দুক থেকে একটা জিনিস চুরি যায়। এ খবর আপনি জানেন?
শশীবাবুর হাতের তুলিটা যেন একমুহূর্তের জন্য কেঁপে গেল। গলার সুরাটাও যেন একটু কাঁপা; বললেন–
আজ পঞ্চাশ বছর হল প্রতি বছর এসে এই একই কাজ করে যাচ্ছি। এই ঘোষালবাড়িতে, আর আমায় কিনা এসে পুলিশে জেরা করল! হাতে তুলি নিলে আমার আর কোনও ইশ থাকে না, জানেন, নাওয়া খাওয়া ভুলে যাই। আপনি জিজ্ঞেস করুন সিংহি মশাইকে, উনি তো মাঝে মাঝে এসে দাঁড়িয়ে দেখেন। আপনি খোকাকে জিজ্ঞেস করুন। সেও তো এসে চুপটি করে দাঁড়িয়ে দেখে আমার কাজ। কই বলুন তো তাঁরা—আমি ঠাকুরের সামনে ছেড়ে একটা মিনিটের জন্যে কোথাও যাই কি না।
শশীবাবুর সঙ্গে আরেকটি বছর কুড়ির ছেলে কাজ করছে। জানলাম ইনিই হলেন শশীবাবুর ছেলে কানাই। কানাইকে তার ঝাপের একটা ইয়াং সংস্করণ বলা চলে। কাজ দেখলে মনে হয় সে বংশের ধারা বজায় রাখতে পারবে। কানাই নাকি গণেশ চুরির দিন সাতটার পরে ঠাকুরের সামনে ছেড়ে কোথাও যায়নি।
বিকাশবাবু আমাদের সঙ্গে গেট অবধি এলেন। ফেলুদা বলল, আপনাদের বাড়িতে এখন অনেক লোক তাই আর উমানাথবাবুকে বিরক্ত করলাম না। আপনি শুধু বলে দেবেন যে আমি হয়তো মাঝে মাঝে এসে একটু ঘুরে টুরে দেখতে পারি, প্রয়োজন হলে একে-ওকে দু-একটা প্রশ্ন করতে পারি।
বিকাশবাবু বললেন, মিস্টার ঘোষাল যখন আপনার উপর ব্যাপারটা ছেড়ে দিয়েছেন তখন তো আপনার সে অধিকার আছেই।
বেরোবার মুখে একটা শব্দ পেয়ে ফেলুদার সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখটাও বাড়ির ছাতের দিকে চলে গেল।
রুকু তার লাল-সাদা পেটকাটিটা সবে মাত্র উড়িয়েছে। সূতোর টানে ঘুড়িটাই হাওয়া কেটে ফরফর শব্দ করছে। রুকুকে এখান থেকে দেখতে পাবার কোনও সম্ভাবনা নেই, তবে তার লাটাই সমেত হাত দুটো মাঝে মাঝে ছাতের পাঁচিলের উপর দিয়ে উঁকি মারছে।
ছেলেটিকে খুব একা বলে মনে হয়, ফেলুদা ঘুড়িটার দিকে চোখ রেখে বলল। সত্যিই কি তাই?
বিকাশবাবু বললেন, রুকু উমানাথবাবুর একমাত্র ছেলে। এখানে তো তবু একটি বন্ধু হয়েছে। আপনি তো দেখেছেন সূর্যকে। কলকাতায় ওর সমবয়সী বন্ধু একটিও নেই।
০৫. আমরা কাশীতে এসেছি
এখানে এসে অবধি বেশির ভাগ সময়টা ঘরে বসে বাঙালিদের সঙ্গে কথা বলে মাঝে ভুলে যেতে হচ্ছিল যে আমরা কাশীতে এসেছি। এখন সাইকেল রিকশা, টাঙ্গা আর লোকের ভিড় বাঁচিয়ে মদনপুরা রোড দিয়ে হাটেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে আবার কাশীর মেজাজটা ফিরে পেলাম। বড় রাস্তার গোলমাল এড়িয়ে হোটেলে যাবার শর্টকাটের গলিটাতে ঢুকলাম আমরা তিনজনে। লালমোহনবাবু একটা ছাগলের বাচ্চার পিঠে ছাতা দিয়ে একটা ছোট খোঁচা মেরে বললেন, আমার একটা ব্যাপার কী জানেন ফেলুবাবু—কলকাতা ছেড়ে বাইরে কোথাও। গেলেই সেই জায়গার মেজাজটা আমাকে কেমন যেন পেয়ে বসে। সেবার রাজস্থান গিয়ে খালি খালি নিজেকে রাজপুত বলে মনে হচ্ছিল। অন্যমনস্ক হয়ে মাথায় হাত দিয়ে পাগড়ির বদলে টাক ফিল করে রীতিমতো চমকে চমকে উঠছিলুম।
এখানে এসে কি জটার অভাব ফিল করে চমকে চমকে উঠছেন?
তা ঘাটে গিয়ে যে একটু বৈরাগী-বৈরাগী ভাব হয়নি তা বলতে পারি না। আবার এই সব অলিগলিতে ঢুকলে মনে হয় কোমরে একটা ছোরা থাকলে হাতলটিতে মাঝে মাঝে বেশ হাত বোলানো যেত।
আমি কিন্তু কালকের সেই লোকটাকে আবার দেখেছি। আমি জানি শংকরী-নিবাস থেকে বেরোবার কিছু পরেই সে আমাদের পিছু নিয়েছে। কিন্তু কালকে ফেলুদার তাচ্ছিল্য ভাবের পর আজ আর কিছু বলতে পারছি না। সকালবেলা গলিতে বিস্তর লোক-কেউ স্নান করে ফিরছে, কেউ বাজার থেকে ফিরছে, কিছু বুড়ো দাওয়ায় বসে আড্ডা মারছে, এখানে ওখানে বাচ্চার দল হইহল্লা করছে।–তারই মধ্যে পিছন ফিরলে চাপা পায়জামার উপর গাঢ় বেগনি চাদর মুড়ি দেওয়া লোকটাকে দেখতে পাচ্ছি। আমাদের বিশ-ত্রিশ হাত পিছনে সমানে আমাদের ফলো করে চলেছে।
লালমোহনবাবু বললেন, আপনার এই গণেশের মামলাটি বিলক্ষণ ডিফিকাল্ট বলে মনে হচ্ছে মশাই।
ফেলুদা বলল, কোনও মামলা একটা বিশেষ অবস্থায় পৌঁছানোর আগে সেটা সহজ কি কঠিন তা বোঝা সম্ভব নয়। আপনার কি ধারণা সেই স্টেজ পৌঁছে গেছে?
যায়নি বুঝি?
একেবারেই না।
কিন্তু যিনি আসল ভিলেন, তাঁর পক্ষে তো ও জিনিস চুরি করার কোনও স্কোপই ছিল না।
কাকে ভিলেন ভাবছেন আপনি?
কেন, ওই যে মেঘরাম না মেঘলাল না। কী নাম বললে। যাকে দেখলুম মছলিবাবার ওখানে।
আপনার কি ধারণা মেঘরাজ গণেশ চুরি করার জন্য নিজেই পাঁচিল টপকে ঘোষাল
বাড়িতে ঢুকবেন?
এজেন্ট লাগবে বলছেন?
সেটাই স্বাভাবিক নয় কি? আর তা ছাড়া সে শাসিয়ে গেছে বলে যে সে-ই চুরি করেছে। এমন তো নাও হতে পারে।
লালমোহনবাবু একটুক্ষণ চুপ মেরে হঠাৎ যেন শিউরে উঠে বললেন, ওরকম কাঁধ দেখিনি মশাই। না জানি সামনের দিক থেকে কী রকম দেখতে। ওর মাথায় এক জোড়া শিং লাগিয়ে বিশ্বনাথের গলিতে ছেড়ে দিলে নিঘ্ঘাৎ ঢুঁ মারবে।