রুক্সিণীকুমার ছাতে আছেন বলে মনে হচ্ছে? ফেলুদা বলল।
আর কোথায় থাকবে বলুন, বিকাশবাবু হেসে বললেন, তার তো এখন বন্দি অবস্থা। আর তা ছাড়া ছাতে তার একটি নিজস্ব ঘর আছে।
সেটা একবার দেখা যায়?
নিশ্চয়ই। সেই সঙ্গে চলুন পিছনের সিঁড়িটাও দেখিয়ে দিই।
একরকম লোহার সিডি হয় যেগুলো বাড়ির বাইরের দেয়াল বেয়ে পাক খেয়ে উপরে উঠে। যায়। এটা দেখলাম সেরকম সিঁড়ি নয়। এটা ইটের তৈরি, আর বাড়ির ভিতরেই। তবে এটাও পাকানো সিঁড়ি। ওঠবার সময় ঠিক মনে হয় কোনও মিনার বা মনুমেন্টে উঠছি।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে সামনেই ছাতের ঘর, আর বাঁ দিকে ছাতে যাবার দরজা। ঘরের ভিতরে মেঝেতে উবু হয়ে বসে আছে রুকু। একটা লাল-সাদা পেটকাটি ঘুড়ি মাটিতে ফেলে হাঁটুর চাপে সেটাকে ধরে রেখে তাতে সুতো পরাচ্ছে। আমাদের আসতে দেখেই কাজটা বন্ধ করে সোজা হয়ে বসল। আমরা চারজনে ছোট্ট ঘরটাতে ঢুকলাম।
বোঝাই যায়। এটা রুকুর খেলার ঘর—যদিও রুকুর জিনিস ছাড়াও আরও অনেক কিছু কোণঠাসা করে রাখা রয়েছে—দুটো পুরনো মরচে ধরা ট্রাঙ্ক, একটা প্যাকিং কেস, একটা ছেঁড়া মাদুর, তিনটে হারিকেন লন্ঠন, একটা কাত করা ঢাকাই জালা, আর কোণে ডাই করা পুরনো খবরের কাগজ আর মাসিক পত্রিকা।
তুমি গোয়েন্দা?
ফেলুদার দিকে সটান একদৃষ্টে তাকিয়ে প্রশ্ন করল রুকু। আজ দেখছি ফরসা রংটা রোদে পুড়ে যেন একটু তামাটে লাগছে। তার মুখে যে চুইং গাম রয়েছে সেটা তার চায়াল নাড়া দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ফেলুদা হেসে বলল, খবরটা ক্যাপ্টেন স্পার্ক কী করে পেলেন সেটা জানতে পারি!
আমার অ্যাসিসট্যান্ট বলেছে, গভীর ভাবে জানাল রুকু। সে আবার ঘুড়ির দিকে মন দিয়েছে।
কে তোমার অ্যাসিসট্যান্ট? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
স্পার্কের অ্যাসিসট্যান্ট খুদে র্যাক্সিট সেটা জান না? তুমি কীরকম গোয়েন্দা।
লালমোহনবাবু ছোট্ট একটা কাশি দিয়ে তাঁর দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, খুদিরাম রক্ষিত। সাড়ে চার ফুট হাইট। স্পার্কের ডান হাত।
ফেলুদা ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে বলল, কোথায় আছে তোমার অ্যাসিসট্যান্ট?
উত্তরটা এল বিকাশবাবুর কাছ থেকে। ভদ্রলোক একটা অপ্রস্তুত হাসি হেসে বললেন, ও ভূমিকাটা এখন আমাকেই পালন করতে হচ্ছে।
তোমার রিভলভার আছে? হঠাৎ প্রশ্ন করল রুকু।
আছে, বলল ফেলুদা।
কী রিভলভার?
কোল্ট।
আর হারপুন?
উঁহু। হারপুন নেই।
তুমি জলের তলায় শিকার করো না?
এখন পর্যন্ত প্রয়োজন হয়নি।
তোমার ছোরা আছে?
ছোরাও নেই। এমনকী এরকম ছোরাও নেই।
রুকুর মাথার উপরেই দেয়ালে পেরেক থেকে একটা খেলার ছোরা ঝুলছে! এটাই কাল ওর কোমরে বাঁধা দেখেছিলাম।
ওই ছোরা আমি শয়তান সিং-এর পেটে ঢুকিয়ে ওর নাড়ির্ভুড়ি বার করে দেব।
সে তো বুঝলাম, ফেলুদা রুকূর পাশে মেঝেতে বসে পড়ে বলল, কিন্তু তোমাদের বাড়ির সিন্দুক থেকে যে একজন শয়তান সিং একটা সোনার গণেশ চুরি করে নিয়ে গেল তার কী হবে?
শয়তান সিং এবাড়িতে ঢুকতেই পারবে না।
ক্যাপ্টেন স্পার্ক সেদিন মছলিবাবাকে দেখতে না গেলে এ ব্যাপারটা হত না-তাই না?
মছলিবাবার গায়ের রংটা কঙ্গোর গঙ্গোরিলার মতো কালো।
সাবাস! বলে উঠল লালমোহনবাবু, তুমি গোরিলার গোগ্রাস পড়েছ রুকুবাবু?
গঙ্গোরিলা যে লালমোহনবাবুরই লেখা গোরিলার গোগ্রাস-এর নব্বই ফুট লম্বা অতিকায় রাক্ষুসে গোরিলার নাম সেটা আমি জানতাম। গল্পের আইডিয়াটা কিং কং থেকে নেওয়া, সেটা লালমোহনবাবু নিজেও স্বীকার করেন। জটায়ুর বর্ণনায় গোরিলার গায়ের রং ছিল কষ্টিপাথরে আলকাতরা মাখালে যেরকম হয় সেইরকম। লালমোহনবাবু ও বইটা আসলে আম-বলেই ফেলুদার কাছ থেকে একটা কড়া ইশারা পেয়ে থেমে গেলেন।
রুকু বলল, গণেশ তো একজন রাজার কাছে আছে। শয়তান সিং পাবেই না। কেউ পাবে না। ডাকু গণ্ডারিয়াও পাবে না।
আবার অক্রুর নন্দী!–দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন জটায়ু।
বিকাশবাবু হেসে বললেন, ওর কথার সঙ্গে তাল রেখে চলতে হলে আগে রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজ গুলে খেতে হবে।
ফেলুদা এখনও মাটিতে বসে আড়চোখে রুকুর দিকে চেয়ে আছে, তার ভাব দেখে মনে হয় যেন সে রুকুর আজগুবি কথাগুলোর ভিতর থেকে আসল মানুষটাকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করছে। রুকু তার কথার মধ্যেই দিব্যি ঘুড়িতে সুতো লাগিয়ে চলেছে। এবার ফেলুদা প্রশ্ন করল, কোথাকার রাজার কথা বলছি তুমি রুকু?
উত্তর এল–আফ্রিকা।
ঘোষালবাড়ি থেকে চলে আসার আগে আমরা আরেকজন লোকের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তিনি হলেন শশিভূষণ, পাল। শশীবাবু নারকোলের মালায় হলদে রং নিয়ে নিজের তৈরি তুলি দিয়ে কার্তিক ঠাকুরের গালে লাগাচ্ছিলেন। ভদ্রলোকের বয়স ষাট পয়ষট্টি হবে নিশ্চয়ই, রোগ প্যাকাটি চেহারা, চোখে পুরু কাচের চশমা! ফেলুদা জিজ্ঞেস করাতে বললেন উনি নাকি ষোলো বছর বয়স থেকে এই কাজ করছেন। ওঁর আদি বাড়ি ছিল কৃষ্ণনগর, ঠাকুরদাদা অধর পাল নাকি প্রথম কাশীতে এসে বসবাস আরম্ভ করেন। সিপাহি বিদ্রোহের দু বছর পরে। শশীবাবু থাকেন। গণেশ মহল্লায়। সেখানে নাকি ওঁরা ছাড়াও আরও কয়েকঘর কুমোর থাকে। ফেলুদা বলল, আপনার জুর হয়েছিল শুনলাম; এখন ভাল আছেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ। সিংহি মশাইয়ের ওষুধে খুব উপকার হয়েছিল।
শশীবাবু কথা বলছেন, কিন্তু কাজ বন্ধ করছেন না।
আপনার কাজ শেষ হচ্ছে কবে? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।