বিকাশবাবুর সঙ্গে কথা শেষ করে আমরা ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে দোতলায় অম্বিকাবাবুর ঘরে গেলাম।
জানালার ধারে একটা পুরনো আরাম কেদারায় বসে বৃদ্ধ ভদ্রলোক নিবিষ্ট মনে স্টেটুসম্যান পড়ছেন। পায়ের আওয়াজ পেয়ে কাগজটা সরিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে সোনার চশমার উপর দিয়ে ভ্রূকুটি করে আমাদের দিকে দেখলেন। ভদ্রলোকের মাথার মাঝখানে টাক, কানের দুপাশে ধপধাপে সাদা চুল, দাড়ি গোঁফ কামানো, দু চোখের উপর কাঁচাপাকা মেশানো ঘন ভুরু।
বিকাশবাবু আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
অম্বিকাবাবু মুখ খুলতেই বুঝলাম যে ওঁর দুপাটি দাঁতই ফলস। কথা বলার সময় কিটু কিটু করে আওয়াজ হয়, মনে হয় এই বুঝি, দাঁত খুলে পড়ল। প্রথমে সোজা লালমোহনবাবুর দিকে চেয়ে বললেন, আপনারাও পুলিশ নাকি? লালমোহনবাবু ভড়কে গিয়ে ঢোক গিলে বললেন, আমি? না না-আমি কিছুই না।
কিছুই না? এ আবার কীরকম বিনয় হল?
না। ইনিই, মানে, গো-গো—
বিকাশবাবু এগিয়ে এসে ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দিলেন।
ইনি প্রদাষ মিত্র। গোয়েন্দা হিসেবে খুব নাম-ডাক। পুলিশ তো কিছুই করতে পারল না, তাই মিস্টার ঘোষাল বলছিলেন…
অম্বিকাবাবু এবার সোজা ফেলুদার দিকে চাইলেন।
উমা কী বলেছে? বলেছে। গণেশ গেছে বলে ঘোষাল বংশ ধ্বংস হয়ে যাবে। ননসেন্স। তার বয়স কত। চল্লিশ পেরোয়নি। আমার তিয়াত্তর। ঘোষাল বংশের ইতিহাস সে আমার চেয়ে বেশি জানে? উমা ব্যবসায়ে উন্নতি করেছে সে কি গণেশের দৌলতে? নিজের বুদ্ধিশুদ্ধি না থাকলে গণেশ কী করবে? আর তার যে বুদ্ধি সে কি গণেশ দিয়েছে? সে বুদ্ধি সে পেয়েছে তার বংশের রক্তের জোরে। নাইনটিন টোয়েন্টিফোরে কেমব্রিজে ম্যাথাম্যাটিকস-এ ট্রাইপস করতে যাচ্ছিল অম্বিকা ঘোষাল—যাকে দেখছ তোমাদের সামনে। যাবার সাতদিন আগে পিঠে কারবাঙ্কল হয়ে যায় যায় অবস্থা। বাঁচিয়ে দিল না হয়। গণেশ, কিন্তু বিলেত যাওয়া যে পাণ্ড হয়ে গেল চিরকালের জন্যে, তার জন্য কে দায়ী?..উমানাথের ব্যবসা বুদ্ধি আছে ঠিকই, তবে ওর জন্মানো উচিত ছিল একশো বছর আগে। এখন তো শুনছি। নাকি কোন এক বাবাজীর কাছে দীক্ষা নেবার মতলব করছে।
তার মানে আপনার গণেশটা যাওয়াতে কোনও আপশোঁস নেই?
অম্বিকাবাবু চশমা খুলে তার ঘোলাটে চোখ দুটো ফেলুদার মুখের উপর ফোকাস করলেন।
গণেশের গলায় একটা হিরে বসানো ছিল সেটার কথা উমানাথ বলেছে?
তা বলেছেন।
কী হিরে তার নাম বলেছে?
না, সেটা বলেননি।
ওই তো। জানে না। তাই বলেনি। বনস্পতি হিরের নাম শুনেছ?
সবুজ রঙের কি?
ফেলুদার এই এককথায় অম্বিকাবাবু নরম হয়ে গেলেন। দৃষ্টিটা নামিয়ে নিয়ে বললেন, অ, তুমি এ বিষয়ে কিছু জানটান দেখছি। অত্যন্ত রেয়ার হিরে। আমার আপশোঁস হয়েছে। কেন জান? শুধু দামি জিনিস বলে নয়; দামি তো বটেই; ওটার জন্য কত ট্যাক্স দিতে হচ্ছিল শুনলে তোমার মাথা ঘুরে যাবে। আসল কথা হচ্ছে—ইট ওয়জ ও ওয়র্ক অফ আর্ট। এসব লাকটাক আমি বিশ্বাস করি না।
ওই টেবিলের দেরাজেই কি চাবিটা ছিল? ফেলুদা প্রশ্ন করল। অম্বিকাবাবুর আরাম কেদারা থেকে তিন-চার হাত দূরেই দুটো জানালার মাঝখানে টেবিলটা। এটা ঘরের দক্ষিণ দিক। সিন্দুকটা রয়েছে উত্তর-পশ্চিম কোণে। দুটোর মাঝখানে একটা প্রকাণ্ড আদ্যিকালের খাট, তার উপর একটা ছ ইঞ্চি পুরু তোশকের উপর শীতলপাটি পাতা। অম্বিকাবাবু ফেলুদার প্রশ্নের কোনও জবাব না দিয়ে উলটে আরেকটা প্রশ্ন করে বসলেন।
আমি সন্ধেবেলা নেশা করি সেটা উমা বলেছে?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
ফেলুদা এত নরমভাবে কারুর সঙ্গে কোনওদিন কথা বলেনি। অম্বিকাবাবু বললেন, গণেশ নাকি চাইলে সিদ্ধি দেন; আমি খাই আফিং। সন্ধের পর আমার বিশেষ ভঁশ থাকে। না। কাজেই সাতটা থেকে আটটার মধ্যে আমার ঘরে কেউ এসেছিল কি না সে কথা আমাকে জিজ্ঞেস করে ফল হবে না।
আপনার চেয়ার এখন যে ভাবে রাখা রয়েছে, সন্ধেবেলাও কি সেইভাবেই থাকে?
না। সকালে কাগজ পড়ি, তাই জানালা থাকে আমার পিছনে। সন্ধেয় আকাশ দেখি, তাই জানালা থাকে সামনে।
তা হলে টেবিলের দিকে পিঠ করা থাকে। তার মানে ওদিকের দরজা দিয়ে কেউ এলে দেখতেই পাবেন না।
না।
ফেলুদা এবার টেবিলটার দিকে এগিয়ে গিয়ে খুব সাবধানে টান দিয়ে দেরাজটা খুলল। কোনও শব্দ হল না; বন্ধ করার বেলাতেও তাই।
এবার ও সিন্দূকটার দিকে এগিয়ে গেল। চৌকির উপরে রাখা পোল্লায় সিন্দুকটা প্রায় আমার বুক অবধি পৌঁছে গেছে!
পুলিশ নিশ্চয়ই এটার ভিতর ভাল করে খুঁজে দেখেছে?
বিকাশবাবু বললেন, তা তো খুঁজেইছে, আঙুলের ছাপের ব্যাপারেও পরীক্ষা করে দেখেছে, কিছুই পায়নি।
অম্বিকাবাবুর ঘরের দরজা দিয়ে বেরোলে ডাইনে পড়ে নীচে যাবার সিঁড়ি, আর বাঁয়ে একটা ছোট্ট ঘর। ঘরটা দিয়ে ডান দিকে বেরিয়ে একটা চওড়া শ্বেত পাথরে বাঁধানো বারান্দা। এটা বাড়ির দক্ষিণ দিক। পুব দিকে বাগানের নিম আর তেঁতুল গাছের মাঝখানের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে দূরে গঙ্গার জল সকালের রোদে চিক্চিক্ করছে। আমাদের সামনে আর ডাইনে বেনারস শহর ছড়িয়ে আছে। আমি মন্দিরের চুড়ো গুনছি, ফেলুদা বিকাশবাবুকে একটা সিগারেট দিয়ে নিজে একটা মুখে পুরেছে, এমন সময় ফুরফুরে হাওয়ার সঙ্গে উপর দিক থেকে কী যেন একটা জিনিস। পাক খেতে খেতে নেমে এসে লালমোহনবাবুর পাঞ্জাবির উপর পড়ল। লালমোহনবাবু সেটা খপ করে ধরে হাতের মুঠো খুলতেই দেখা গেল সেটা আর কিছুই না—একটা চুইং গামের র্যাপার।