পরদিন সকালে সাড়ে সাতটার মধ্যে আমরা তিনজন চানটান করে চা ডিম রুটি খেয়ে রেডি। বেরোবার মুখে নিরঞ্জনবাবুর সঙ্গে দেখা হল। ফেলুদা দুটো আজেবাজে কথার পর জিজ্ঞেস করল, মগনলাল মেঘরাজের বাড়িটা কোথায় জানেন?
মেঘরাজ? যদ্দূর জানি ওরা দুটো বাড়ি আছে। শহরে, দুটোই একেবারে হার্ট অফ কাশীতে। একটা বোধহয় জ্ঞানবাপীর উত্তর দিকের গলিটায়। আপনি ওখানে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে। পরম ধামিক তো, তাই একেবারে খোদ বিশ্বনাথের ঘণ্টা শুনতে শুনতে টাকার হিসেব করে।
নিরঞ্জনবাবুর কাছ থেকে আরেকটা খবর পেলাম। মছলিবাবা নাকি আর ছদিন আছেন শহরে। কথাটা শুনে ফেলুদা শুধু ওর একপেশে হাসিটা হাসল, মুখে কিছু বলল না।
ঘড়ি ধরে আটটার সময় আমরা শংকরী নিবাসের গেটের সামনে গিয়ে হাজির হলাম।
ত্রিলোচনের চেহারাটা রাত্রে ভাল করে দেখিনি, আজ দিনের আলোতে গালপাট্টার বহর দেখে বেশ হকচকিয়ে গেলাম। বয়স সত্তর-টত্তর হবে নিশ্চয়ই, তবে এখনও মেরুদণ্ড একদম সোজা। আমাদের দেখেই হাসির সঙ্গে একটা স্মার্ট স্যালুট ঠকে গোটটা খুলে দিল।
গাড়িবারান্দার দিকে কিছুদূর এগিয়ে যেতেই বিকাশবাবু বেরিয়ে এলেন।
জানালা দিয়ে দেখলাম আপনাদের ঢুকতে। ভদ্রলোক বোধহয় সবেমাত্র দাড়ি কামিয়েছেন; বাঁ দিকের জুলপির নীচে এখনও সাবান লেগে রয়েছে। ভেতরে যাবেন? কতামশাই কিন্তু রেডি। আপনি ওঁর সঙ্গেই আগে কথা বলবেন তো?
ফেলুদা বলল, তার আগে আপনার কাছ থেকে কিছু তথ্য জেনে নাট করে নিতে চাই।
বেশ তো, বলুন না। কী জানতে চান।
বিকাশবাবুর কাছ থেকে কতকগুলো তারিখ নোট করে নিয়ে খাতায় যা দাঁড়াল তা এই—
১। মগনলাল উমানাথবাবুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন ১০ই অক্টোবর।
২। উমানাথবাবু তাঁর স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে মছলিবাবা দর্শনে যান ১৫ই অক্টোবর সন্ধে সাড়ে সাতটায়। বাড়ি ফেরেন সাড়ে আটটার কিছু পরে। এই সময়ের মধ্যেই গণেশ চুরি যায়।
৩। ১৫ই অক্টোবর সাড়ে সাতটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে শংকরীনিবাসে ছিল—উমানাথবাবুর বাবা অম্বিকা ঘোষাল, বিকাশ সিংহ, অম্বিকাবাবুর বেয়ারা বৈকুণ্ঠ, চাকর ভরদ্বাজ, ঝি সৌদামিনী, ঠাকুর নিত্যানন্দ, মালী লক্ষ্মণ, তার বউ আর তাদের একটি সাত বছরের ছেলে, দারোয়ান ত্ৰিলোচন, প্রতিমার কারিগর শশী পাল ও তাঁর ছেলে কানাই, আর প্রতিমার কাজে জোগান দেবার একজন লোক, নাম নিবারণ। ওই এক ঘণ্টার মধ্যে বাইরে থেকে কেউ না এসে থাকলে বুঝতে হবে এদেরই মধ্যে কেউ না কেউ অম্বিকাবাবুর ঘরে ঢুকে তার টেবিলের দেরাজ থেকে চাবি নিয়ে সিন্দুক খুলে গণেশ বার করে নিয়েছিল।
খাতায় নোট করা শেষ হলে ফেলুদা বিকাশবাবুর দিকে ফিরে বলল, কিছু মনে করবেন না—এ ব্যাপারে তো কাউকে বাদ দেওয়া চলে না, কাজেই আপনাকেও—
ফেলুদার কথা শেষ হবার আগেই বিকাশবাবু হেসে বললেন, বুঝেছি; এ ব্যাপারটা পুলিশের সঙ্গে এক দফা হয়ে গেছে। আমি সেদিন ওই এক ঘণ্টা সময়টা কী করছিলাম সেটা জানতে চাইছেন তো?
হ্যাঁ–তবে তার আগে একটা প্রশ্ন আছে।
বলুন। -কিন্তু এখানে কেন, আমার ঘরে চলুন।
বাড়ির সামনের দরজা দিয়ে ঢুকে ডান দিকে দোতলায় যাবার সিঁড়ি, আর বা দিকে বিকাশবাবুর ঘর। বাকি কথা ঘরে বসেই হল।
ফেলুদা বলল, আপনি গণেশের কথাটা জানতেন নিশ্চয়ই।
অনেক’দিন থেকেই জানি।
মগনলাল যেদিন উমানাথবাবুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন সেদিন আপনি বাড়িতে ছিলেন?
হ্যাঁ। আমিই মগনলালকে রিসিভ করে বৈঠকখানায় বসাই। তারপর ভরদ্বাজকে দিয়ে দোতলায় মিস্টার ঘোষালের কাছে খবর পাঠাই।
তারপর?
তারপর আমি নিজের ঘরে চলে আসি।
দুজনের মধ্যে যে কথাকাটাকাটি হয়েছিল সেটা আপনি জানতেন?
না। আমার ঘর থেকে বৈঠকখানার কথাবার্তা কিছু শোনা যায় না। তা ছাড়া আমার ঘরে তখন রেডিয়ো চলছিল।
যেদিন গণেশটা চুরি গেল, সেদিনও কি আপনি আপনার ঘরেই ছিলেন?
বেশির ভাগ সময়! মিস্টার ঘোষালরা যখন বাইরে যান। তখন আমি ওঁদের গোট পর্যন্ত পৌঁছে দিই। ওখান থেকে যাই পুজোমণ্ডপে। শশীবাবুর কাজ দেখতে বেশ লাগে। সেদিন ভদ্রলোককে দেখে অসুস্থ মনে হল। জিজ্ঞেস করাতে বললেন শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। আমি ঘরে এসে ওষুধ নিয়ে ওকে দিয়ে আসি।
হোমিওপ্যাথিক কি? আপনার শেলফে দুটো হোমিওপ্যাথির বই দেখছি।
হ্যাঁ, হোমিওপ্যাথিক।
কী ওষুধ জানতে পারি?
পাসসেটিলা থার্টি।
ওষুধ দিয়ে ঘরে ফিরে আসেন?
হ্যাঁ!
কী করছিলেন ঘরে?
লিখনী রেডিয়ো থেকে আখতারি বাঈয়ের রেকর্ড দিচ্ছিল–তাই শুনছিলাম।
কতক্ষণ রেডিয়ো শোনেন?
ওটা চালানোই ছিল। আমি ম্যাগাজিন পড়ছিলাম। ইলাসট্রেটেড উইকলি।
তারপর মিস্টার ঘোষাল ফেরা না পর্যন্ত আর বাইরে বেরোন নি?
না। বেঙ্গলি ক্লাব কাবুলিওয়ালা থিয়েটার করছে; ওদের তরফ থেকে দুজনের আসার কথা ছিল মিস্টার ঘোষালের সঙ্গে দেখা করার জন্য।–বোধহয় প্রধান অতিথি হওয়ার জন্য অনুরোধ করতে। ওদের আসার অপেক্ষায় বসে ছিলাম।
ওরা এসেছিলেন?
অনেক পরে। নটার পরে।
ফেলুদা দরজা দিয়ে দোতলায় যাবার সিঁড়িটার দিকে দেখিয়ে বললেন, আপনি যেখানে বসেছিলেন সেখান থেকে ওই সিঁড়িটা দেখা যাচ্ছিল কি?
হ্যাঁ।
ওটা দিয়ে কাউকে উঠতে বা নামতে দেখেছিলেন বলে মনে পড়ে?
না। তবে ওটা ছাড়াও আরেকটা সিঁড়ি আছে। পিছন দিকে। জমাদারের সিঁড়ি। সেটা দিয়ে কেউ উঠে থাকলে আমার জানার কথা নয়।