আওরঙ্গাবাদ যাচ্ছে? আমি জায়গাটিার নামই শুনিনি।
আওরঙ্গাবাদ, ফেলুদা বলল। আর আমরা এখন যাচ্ছি সদার শঙ্কর রোড, শ্ৰীসিদ্ধেশ্বর বোসের বাড়ি। একটা কনসালটেশনের দরকার।
০৪. আওরঙ্গাবাদ
আওরঙ্গাবাদ!
সিধুজ্যাঠার চোখ কপালে উঠে গেল। —এ যে সব্বোনাশের মাথায় বাড়ি! জায়গাটার তাৎপর্য বুঝতে পারছ ফেলু? আওরঙ্গাবাদ হল এলোরায় যাবার ঘাঁটি। মাত্র বিশ মাইলের পথ, চমৎকার রাস্তা। আর এলোরার মানে বুঝতে পারছ তো? এলোরা হল ভারতের সেরা আর্টের ডিপো! পাহাড়ের গা থেকে কেটে বার করা কৈলাসের মন্দির-যা দেখে মুখের কথা আপন থেকেই বন্ধ হয়ে যায়। আর তা ছাড়া পাহাড়ের গায়ে লাইন করে দেড় মাইল জায়গা জুড়ে আরও তেত্ৰিশটা গুহা-হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন-তার প্রত্যেকটা মূর্তি আর কারুকার্যে ঠাসা। আমার তো ভাবতেই রক্ত হিম হয়ে যাচ্ছে!…কিন্তু প্লেন থাকতে ট্রেনে যাচ্ছে কেন লোকটা?
যদ্দূর মনে হয়, মূর্তিটা ও হাতের কাছে রাখতে চাইছে। প্লেনে গেলে সিকিউরিটি চেক-এর ব্যাপার আছে। হাতের ব্যাগ খুলে দেখে পুলিশ। ট্রেনে সে ঝামেলা নেই।
আওরঙ্গাবাদের ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমারও গলা শুকিয়ে গেল। ফেলুদা হাতের ঘড়ির দিকে দেখে তড়িাক করে মোড়া ছেড়ে উঠে পড়ল।
কী ঠিক করলে? সিধুজ্যাঠা জিজ্ঞেস করলেন।
আমাদের প্লেনেই যেতে হবে।
সিধুজ্যাঠা যে ভাবে ফেলুদার দিকে চাইলেন তাতে বুঝলাম গর্বে ওঁর বুকটা ভরে উঠেছে। মুখে কিছু না বলে তক্তপোশ থেকে উঠে গিয়ে আলমারি থেকে একটা চটি বই বার করে ফেলুদার হাতে দিয়ে বললেন, এটা তোমায় হেলপ করবে। ভাল করে একবারটি পড়ে নিয়ো।
বইটার নাম এ গাইড টু দ্য কেভস অফ এলোরা।
ফেলুদা বাড়ি এসেই জুপিটার ট্র্যাভলসের মিস্টার বকসীকে ফোন করে জিজ্ঞেস করল। আগামীকাল সকালের বম্বে ফ্লাইটে টিকিট আছে কি না; ওর তিনটে সিটি দরকার। তিনটে শুনে আমি বেশ অবাক হয়ে গেলাম। সিধুজ্যাঠাও যাবেন নাকি সঙ্গে? ফেলুদাকে জিজ্ঞেস করাতে ও শুধু বলল, দলে আরেকটু ভারী হলে সুবিধে হয়।
বকসী বললেন, এমনিতে জায়গা নেই, তবে ওয়েটিং লিস্টে ভাল পোজিশন। আমি টিকিট ইসূঢ় করে দিচ্ছি। আপনারা সকলে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে এয়ারপোর্টে এসে যাবেন। মনে হয় হয়ে যাবে।
সকালের ফ্লাইট নটার মধ্যে বম্বে পৌঁছে যাবে; তারপর সেখান থেকে সাড়ে বারোটার সময় আরেকটা প্লেন ছেড়ে দেড়টায় আমাদের আওরঙ্গাবাদ পৌঁছে দেবে। এই পরের টিকিটটাও জুপিটার করে দেবে, আর দেবে আমাদের আওরঙ্গাবাদ ও এলোরার থাকার ব্যবস্থা। আমরা পৌঁছে যাব কালই, মানে শনিবার, আর মল্লিক পৌঁছবেন রবিবার।
বুকিং-এর ঝামেলা মিটিয়ে ফেলুদা আরেকটা নম্বর ডায়াল করছে, এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। দরজা খুলতেই দেখি নাম্বার ওয়ান জনপ্রিয় রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস লেখক লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ু। ফেলুদা যেন ভূত দেখেছে এমন ভাব করে রিসিভারটা রেখে দিয়ে বলল, আশ্চর্য-এই মুহূর্তে আপনার নম্বর ডায়াল করছিলাম।
জটায়ু তার ভাঁজ করা প্লাস্টিকের রেনকোটটা টেবিলের উপর রেখে সোফায় বসে পড়ে বললেন, তা হলে আমার সঙ্গে আপনার একটা টেলিপ্যাথেটিক যোগ রয়েছে বলুন! আমারও ক’দিন থেকেই আপনার কথা মনে হচ্ছে।
কথাটা আসলে হবে টেলিপ্যাথিক, কিন্তু লালমোহনবাবুর ইংরেজি ওইরকমই। ভদ্রলোকের চেহারা বেশ খোলতাই হয়েছে; দেখে মনে হল বই লিখে বেশ দু পয়সী। রোজগার হচ্ছে।
বেশ করে একটু লেবুর সরবত করতে বলুন তো আপনার সারভেন্টটিকে-বড্ড গুমোট করেছে। আর ফ্রিডিজেয়ার থেকে যদি একটু বরফ দিয়ে দেয়…
সরবতের আড়ার দিয়ে ফেলুদা কাজের কথায় চলে গেল।
খুব ব্যস্ত নাকি? নতুন উপন্যাসে হাত দিয়েছেন?
হাত দিলে কি আর এখানে আসতে পারি? ছক কেটিচি। খুব জমবে বলে মনে হয়। ভাল ফিলিম হয়। অবিশ্যি হিন্দি প্যাটার্নের। পাঁচখানা ফাইট আছে। বেলুচিস্তানের ব্যাকগ্রাউন্ডে ফেলিচি আমার হিরো প্রখর রুদ্রকে। আচ্ছা-অৰ্জ্জুন মেরহাত্রাকে কেমন মানায় বলুন তো হিরোর পার্টে? অবিশ্যি আপনি যদি অ্যাকটিং করতে রাজি হন তা হলে তো–
আমি হিন্দি জানি না। যাই হাক, আপাতত আমাদের সঙ্গে আসুন-কৈলাসটা ঘুরে আসি। ফিরে এসে না হয় বেলুচিস্তানের কথা ভাববেন।
কৈলাস। সে কী মশাই–আপনার কি তিব্বতে কেস পড়ল না কি? সেখানে তো শুনিচি চিনেদের রাজত্ব।
কৈলাস পাহাড় নয়। কৈলাস মন্দির। এলোরার নাম শুনেছেন?
ও হা হা, তাই বলুন। তা সে তো শুনিচি সব মন্দির আর মূর্তি টুর্তির ব্যাপার। আপনি হঠাৎ পাথর নিয়ে পড়লেন কেন? আপনার তো মানুষ নিয়ে কারবার।
কারণ, কতগুলো মানুষ ওই পাথর নিয়ে একটা কারবার কেঁদে বসেছে। বিশ্ৰী কারবার। সেটা বন্ধ করা দরকার।
লালমোহনবাবু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছেন দেখে ফেলুদা ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল। সব শুনেটুনে লালমোহনবাবুর গোল চোখ আরও গোল হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে একটা ছোট্ট নোটবুক বার করে কী সব লিখেটিখে নিয়ে বললেন–
এ এক নতুন খবর দিলেন। আপনি। এই সব পাথরের মূর্তির এত দাম? আমি তো জানতুম হিরে পান্না চুনি–এই সব হল দামি পাথর। যাকে বলে প্রেশাস স্টোনস। কিন্তু এও তো দেখছি কম প্রেশাস নয়।
আরও বেশি প্রেশাস। চুনি পান্না পৃথিবীতে হাজার হাজার আছে, ভবিষ্যতে সংখ্যায় আরও বাড়বে। কিন্তু কৈলাসের মন্দির বা সাঁচির স্তুপ বা এলিফ্যান্টার গুহা-এ সব একটা বই দুটো নেই। হাজার-দু হাজার বছর আগে আমাদের আর্ট যে হাইটে উঠেছিল। সে হাইটে ওঠার কথা আজকের আর্টিস্ট ভাবতেই পারে না। সুতরাং সে যুগের আর্ট দেশে যা আছে তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। যারা তাকে নষ্ট করতে চায় তারা ক্রিমিনাল। আমার মতে ভুবনেশ্বরের যক্ষীকে হত্যা করা হয়েছে। যে করেছে তার কঠিন শাস্তি হওয়া দরকার।