যাব সারা?
অ্যালবৎ।
আমাদের ট্যাক্সিও গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকাল। একটা প্ৰকাণ্ড খোলা জায়গা; তার মাঝখানে একটা পার্ক, আর চারদিকে ঘিরে রয়েছে পাঁচ-ছাতলা উঁচু সব বাড়ি। পর্কের চারদিকে গাড়ি পার্ক করা রয়েছে, তার মধ্যে আবার দু-একটা স্কুটারও রয়েছে; আমাদের ডান দিকে কুইনস ম্যানসন। আমরা ট্যাক্সি দাঁড় করলাম, নীল গাড়ি কিছু দূরে একেবারে শেষ মাথায় গিয়ে থামল। আমরা গাড়ির ভিতরে বসে আছি কী হয় দেখার জন্য।
ভদ্রলোক একটা কালো ব্যাগ হাতে নিয়ে নামলেন, দরজার কাচ তুললেন, দরজা লক করলেন, তারপর ডান দিকে গিয়ে একটা বড় দরজা দিয়ে কুইনস ম্যানসনে ঢুকে গেলেন।
এক মিনিট অপেক্ষা করে ফেলুদাও ট্যাক্সি থেকে নামল আমি তার পিছনে। সোজা চলে গেলাম সেই দরজার দিকে। একটা ঘড় ঘড় শব্দ আগেই কানে এল; গিয়ে দেখি দরজা দিয়ে ঢুকেই একটা আদ্যিকালের লিফট, সেটা সবেমাত্র নীচে নেমেছে। ঝটপটাং শব্দ করে লোহার কোলাপসিবল দরজা খুলে বুড়ো লিফটম্যান খাঁচা থেকে বেরিয়ে এল। ফেলুদা হঠাৎ একটা ব্যস্ততার ভাব করে তাকে জিজ্ঞেস করল, মিস্টার সেনগুপ্ত এইমাত্র ওপরে গেলেন না?
সেনগুপ্ত কোন?
এইমাত্র যিনি ওপরে গেলেন?
আভভি গিয়া পাঁচ নম্বরকা মিস্টার মল্লিক। সেনগুপ্ত ইহা কোই নেহি রহ্তা।
ও। আমারই ভুল।
পাঁচ নম্বর ফ্ল্যাট। মিস্টার মল্লিক। এগুলো মনে রাখতে হবে। ফেলুদা খাতা আনেনি; বাড়ি গিয়ে নোট করে নেবে নিশ্চয়ই।
কিন্তু বাড়ি ফিরতে যে এখনও দেরি সেটা একটু পরেই বুঝলাম। ফেলুদা বলরামবাবুকে ভাড়া চুকিয়ে ছেড়ে দিল, ভদ্রলোক যাবার সময় একটা স্লিপ দিয়ে বলে গেলেন, এটা আমার পাশের বাড়ির টেলিফোন, আপনি বললে আমায় ডেকে দেবে। দরকার-টরকার পড়লে একটু খবর দেবেন। স্যার। একঘেয়ে কাজের মধ্যে যদি মাঝে মাঝে…।
পার্ক স্ট্রিট থানার ও সি মিস্টার হরেন মুৎসুদ্দির সঙ্গে ফেলুদার আলাপ ছিল। দু বছর। আগে হ্যাঁপি-গো-লাকি বলে একটা রেসের ঘোড়াকে বিষ খাইয়ে মারার রহস্য ফেলুদা আশ্চৰ্যভাবে সমাধান করেছিল; তখনই মুৎসুদ্দির সঙ্গে আলাপ হয়। আমরা এখন তাঁর আপিসে। ভদ্রলোক মূর্তি চুরির খবরটা কাগজে পড়েছেন। ফেলুদা সেইখান থেকে শুরু করে আজকের পুরো ঘটনাটা তাঁকে বলে বলল, যদ্দূর মনে হয় এই মল্লিক চুরির ব্যাপারটা নিজে না করলেও, চোরাই মাল উদ্ধার করে সেটাকে পাচার করার ভারটা নিজেই নিয়েছে। তার সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ ইনফরমেশন, আর একটি লোক তাঁর পিছনে রাখা—এই দুটো অনুরোধ করতে আমি এসেছি। তার কার্যকলাপের দিকে একটু নজর রাখা দরকার। মিস্টার মল্লিক, পাঁচ নম্বর কুইনস ম্যানসন, নীল অ্যাম্বাসাডর, নম্বর ডব্লু এম এ ফাইভ থ্রি ফোর নাইন।
মুৎসুদ্দি এতক্ষণ একটা পেনসিল কানের মধ্যে খুঁজে বসেছিলেন, এবার সেটাকে টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে বললেন, হবে। আপনি যখন বলছেন তখন হবে। একটা স্পেশাল কনস্টেবল লাগিয়ে দিচ্ছি, সে ওকে চোখে চাখে রাখবে। আর আমাদের ফাইলে যদি কিছু থাকে তাও দেখছি। থাকবেই যে এমন কোনও কথা নেই, যদি না লোকটা এর আগে কোনও গণ্ডগোল করে পুলিশের নজরে এসে থাকে।
ব্যাপারটা খুব আর্জেন্ট কিন্তু। মূর্তি আবার বেহাত হলেই মুশকিল।
মুৎসুদ্দি মুচকি হেসে বললেন, কেন, মুশকিল কেন? আমরা তো আর ঘোড়ার ঘাস কাটি না, মিস্টার মিত্তির। আপনি একা ম্যানেজ করতে না পারলে আমাদের সাহায্য চাইলে আমরা কি আর রিফিউজ করব? আমরা আছি কীসের জন্য? পাবলিককে হেলপ করার জন্যেই তো? তবে একটা কথা বলি–একটা অ্যাডভাইস, অ্যাজ এ ফ্রেন্ড-এই সব র্যাকেটের পেছনে মাঝে মাঝে এক একটা দল থাকে-গ্যাং-এবং তারা বেশ পাওয়ারফুল হয়। গায়ের জোর বলছি না। পয়সার জোর। পোজিশনের জোর। শিক্ষিত অবস্থাপন্ন লোকেরা যখন নোংরা কাজে নামে, তখন সাধারণ ক্রিমিন্যালদের চেয়ে তাদের বাগে আনা অনেক বেশি শক্ত হয়, জানেন তো? আপনি ইয়াং, ট্যালেন্টেড, তাই আপনাকে এগুলো বলছি।–নইলে আর আমার কী মাথাব্যথা বলুন!…
ওয়ালডর্ফে চিনে খাবার অডার দিয়ে ফেলুদা ম্যানেজারের ঘর থেকে কুইন্স ম্যানসন পাঁচ নম্বরে একটা টেলিফোন করে, হ্যালো শুনেই ফোনটা রেখে দিয়ে খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে বলল, লোকটা এখনও ঘরেই আছে।
আমরা বাড়ি ফিরলাম পীনে তিনটেয়। চারটের কিছু পরে মিস্টার মুৎসুদ্দির টেলিফোন এল। প্রায় পাঁচ মিনিট কথা হল, সেটা সঙ্গে সঙ্গে ফেলুদা তার খাতায় নোট করে নিল। তারপর আমি না জিজ্ঞেস করতেই আমার কৌতুহল মিটিয়ে দিল। —
লোকটার পুরো নাম জয়ন্ত মল্লিক। দিন পনেরো হল কুইনস ম্যানসনে এসে রয়েছে। ফ্ল্যাটটা আসলে মিস্টার অধিকারী বলে একজন ভদ্রলোকের। ইনি ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের এক রেস্টোরেন্টের মালিক। বোধহয় মল্লিকের বন্ধু। অধিকারী এখন দাৰ্জিলিঙ-এ। তার অবর্তমানে মল্লিক ফ্ল্যাটটা ব্যবহার করছে। গাড়িটাও অধিকারীর। সেই গাড়ি করেই মল্লিক আজ তিনটে নাগাদ গ্র্যান্ড হোটেলে গিয়েছিল। ভিতরে ঢুকে পাঁচ মিনিট পরে বেরিয়ে এসে বাইরে অপেক্ষা করতে থাকে। কুড়ি মিনিট অপেক্ষা করার পর আবার ভিতরে ঢেকে। দশ মিনিট পরে বেরিয়ে এসে গাড়িতে করে ডালহৌসি যায়। সেখানে কিছুক্ষণের জন্য মুৎসুদ্দির লোক ওকে হারিয়ে ফেলে, তারপর ফেয়ারলি প্লেসে রেলওয়ে বুকিং আপিসের বাইরে গাড়ি দেখে ভিতরে ঢুকে দেখে, মল্লিক। কিউয়ে দাঁড়িয়ে টিকিট কিনছে। এখান থেকে মনমড়, সেখান থেকে আওরঙ্গাবাদ। সেকেণ্ড ক্লাসের রিজার্ভ টিকিট। আরও খবর থাকলে পরে টেলিফোন করবে।