এই এক ঘণ্টার রোদেই রাস্তা অনেকটা শুকিয়ে গেছে, মনে মনে ভাবছি। বলরামবাবু আরেকটু স্পিড তুললে পারেন, এমন সময় হঠাৎ একটা জিনিস চোখে পড়ায় পালস রেট-টা ধাঁ করে বেড়ে গেল।
একটা গাড়ি-মেরামতের দোকানের সামনে একটা নীল অ্যাম্বাসাডর দাঁড়িয়ে আছে।
বলরামবাবু যে সিদিকপুরের কথাবার্তা মন দিয়ে শুনেছিলেন সেটা তার প্রশ্ন থেকে বুঝতে পারলাম। —গাড়ি থামাব স্যার?
সামনের চায়ের দোকানটায়, ফেলুদা চাপা গলায় জবাব দিল।
বলরামবাবু স্টাইলের মাথায় মেরামতির দাকানের দুটো দোকানের পরে ট্যাক্সিটাকে রাস্তার ডান দিকে নিয়ে গিয়ে ঘৰ্য্য-ষ করে ব্রেক কষলেন। ফেলুদা গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে তিন কাপ চা অডার দিল। কাপ তো নয়, কাচের গেলাস।
আর কী আছে ভাই?
বিস্কুট খাবেন? ভাল বিস্কুট আছে।
কাচের বায়ামের মধ্যে গাল গাল নানখাটাই টাইপের বিস্কুট, ফেলুদা তারই দুটো করে দিতে বলল।
আমার চোখ নীল অ্যাম্বাসাডারের দিকে। পাংচার সারানো হচ্ছে। একটি ভদ্রলোক, মাঝারি হাইট, মাঝারি রং, বয়স চল্লিশ-টল্লিশ, ঘন ভুরু, ঘন হাতের লোম, কনের পাশ দিয়েও বোধহয় লোম বেরিয়েছে, মাথার চুল ব্যাকব্রাশ করে আঁচড়ানো। গাড়ির পাশে ছটফট ভাব করে পায়চারি করছেন আর ঘন ঘন টান দিচ্ছেন আধপোড়া সিগারেটে। বাঙালি কি? কথা না বললে বোঝার উপায় নেই।
চা তৈরি হচ্ছে। ফেলুদা চারমিনার বার করে একটা মুখে পুরে পকেট চাপড়ে দেশলাই না-পাওয়ার ভান করে ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে গেল। আমি আমাদের ট্যাক্সির কাছেই রয়ে গেলাম। দুই গাড়ির মধ্যে তফাত বিশ-পঁচিশ হাত। বলরামবাবুর আড়াচোখ নীল গাড়ির দিকে।
এক্সকিউজ মি, আপনার কাছে কি…
ভদ্রলোক পকেট থেকে একটা লাইটার বার করে জ্বলিয়ে ফেলুদার দিকে এগিয়ে দিলেন।
থ্যাঙ্কস। ফেলুদা ধোঁয়া ছাড়ল। টেরিবল ব্যাপার!
ভদ্রলোক ফেলুদার দিকে চেয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিলেন।
আপনি তো ক্র্যাশের ওখানে গিয়েছিলেন, ফেলুদা বলল। —আপনার গাড়িটা যেন আসতে দেখলাম…?
ক্র্যাশ?
আপনি জানেন না? কাঠমাণ্ডুর প্লেন…সিদিকপুরে…
আমি টাকি থেকে আসছি।
টাকি হল হাসনাবাদের কাছেই একটা শহর।
আমরা কি তা হলে ভুল করলাম? গাড়ির নম্বরটা যদি দেখে রাখতাম তা হলে খুব ভাল
হত।
আর কতক্ষণ লাগবে হে? ভদ্রলোক অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করলেন মেরামতির লোকটাকে। এই হয়ে গেল স্যার। পাঁচ মিনিট। চায়ের দোকান থেকে বলরামবাবু হাঁক দিয়ে জানালেন চা রেডি। ফেলুদা নীল গাড়ি ছেড়ে আমাদের হলদে গাড়ির দিকে এগিয়ে এল। হাতে গেলাস নিয়ে তিনজনে দোকানের সামনের বেঞ্চিতে বসার পর ফেলুদা চাপা গলায় বলল, ডিনাই করছে। ডাহা মিথ্যেবাদী।
আমি বললাম, কিন্তু নীল অ্যাম্বাসাডর তো আরও অনেক আছে। এ রংটা তো খুব কমন, ফেলুদা।
লোকটার জুতোয় এখনও কালো ছাইয়ের দাগ লেগে আছে। তোর নিজের স্যান্ড্যালটার দিকে চেয়ে দেখেছিস একবার?
সত্যিই তো! স্যান্ড্যালের রংটাই বদলে গেছে। ক্র্যাশের জায়গায় গিয়ে। আর ওই ভদ্রলোকেরও তাই। ব্ৰাউন জুতোয় কালোর ছোপ।
ফেলুদা যে ইচ্ছে করেই ধীরে সুস্থে বিস্কুট খাচ্ছে সেটা বেশ বুঝতে পারছিলাম। পাঁচ মিনিটের জায়গায় পনেরো মিনিট পরে অন্য গাড়িটা সুস্থ অবস্থায় মেরামতির দোকান থেকে বেরিয়ে যশোহর রোড দিয়ে কলকাতার দিকে রওনা দিল। আর তার পরমুহূর্তেই আমাদের গাড়িও ধাওয়া করল তার পিছনে। দুটোর মাঝখানে বেশ অনেকখানি ফাঁক, কিন্তু ফেলুদা বলল সেই ভাল; লোকটার সন্দেহ উদ্রেক করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
দমদমের কাছে এসে হঠাৎ আরেক পশলা বৃষ্টি নামল। সামনে সব ধোঁয়াটে হয়ে গেছে, ভাল দেখা যাচ্ছে না, তাই বলরামবাবুকে বাধ্য হয়েই স্পিড বাড়িয়ে নীল গাড়ির আরেকটু কাছাকাছি গিয়ে পড়তে হল। ভদ্রলোক বেশ রসিক; বললেন, হিন্দি ফিল্মের মতন মনে হচ্ছে স্যার। সেদিন শত্ৰুঘনের একটা বইয়ে দেখলুম। এইভাবে গাড়ির পেছনে গাড়ি ফলো করছে। অবিশ্যি সেখানে পেছনের গাড়িটা একটা পাহাড়ের গায়ে ক্র্যাশ করল।
ফেলুদা বলল, এক’দিনে একটা ক্র্যাশই যথেষ্ট। আপনি স্টেডি থাকুন। কলকাতায় পাহাড় না থাকলেও—
কী বলচেন স্যার! থাটিন ইয়ারস গাড়ি চালাচ্ছি-এখনও পর্যন্ত একটিও নষ্ট এ সিঙ্গল অ্যাক্সিডেন্ট।
ডব্লু এম এ ফাইভ থ্রি ফোর নাইন, ফেলুদা বিড়বিড় করে বলল। আমিও নম্বরটা মাথায় রেখে দিলাম, আর বার বার পাঁতিচান, পতিচান, পতিচান আওড়ে নিলাম। এটা আর কিছুই নয়–পাঁচ তিন চার আর নায়ের প্রথম অক্ষরগুলো দিয়ে তৈরি। নম্বর মনে রাখার দু-তিন রকম উপায় ফেলুদা শিখিয়ে দিয়েছে, তার মধ্যে এটা একটা।
বলরামবাবু সত্যিই বাহাদুর ড্রাইভার, কারণ কলকাতার ট্র্যাফিকে ভরা গিজগিজে রাস্তা দিয়েও ঠিক নীল গাড়িকে সামনে রেখে চলেছেন। কোথায় যাচ্ছে গাড়িটা কে জানে।
মূর্তিটা নিয়ে কী করবে বলে তো লোকটা? শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করলাম ফেলুদাকে।ভুবনেশ্বরে ফেরত নিয়ে যাবে না নিশ্চয়ই। যে জাতের ধুরন্ধর, তাতে মনে হয় আবার আরেকজন বিদেশি খদ্দের জোগাড় করার চেষ্টা করবে। একই জিনিস উপরো-উপরি দুবার বিক্রি করার এমন সুযোগ তো চট করে আসে না।
নীল গাড়ি শেষ পর্যন্ত দেখি আমাদের পার্ক স্ট্রিটে এনে ফেলেছে। পুরনো গোরস্থান ছাড়িয়ে, লাউডন স্ট্রিট, ক্যামাক স্ট্রিটের মোড় ছড়িয়ে শেষে গাড়ি দেখি হঠাৎ বাঁ দিকে মোড় নিয়ে কুইন্স ম্যানসনের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকছে।