আসলে, পুলিশ জায়গাটাকে ঘিরে ফেলেছে, তাই কাছে যাবার কোনও উপায় নেই।
আমরা অগত্যা ঘেরাও-করা জায়গাটার পাশ দিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করলাম। পুলিশ মাটি থেকে জিনিস তুলে তুলে দেখছে। কোনওটাই আস্ত নেই, তবে ভাঙা বা আধাপোড়া অবস্থাতেও অনেক জিনিস দিব্যি চেনা যাচ্ছে। একটা স্টেথোস্কোপের কানো দেবার অংশ, একটা ব্রিফ কেস, জলের ফ্লাস্ক, একটা বাধহয় হ্যান্ডব্যাগের আয়না–যেটা একটা পুলিশ হাতে নিয়ে এদিক ওদিক নাড়ার ফলে তার থেকে রোদের ঝিলিক বেরোচ্ছে।
আমাদের ডান দিকে ক্র্যাশের জায়গা, আমরা তার পাশ দিয়ে গোল হয়ে ঘুরে এগিয়ে যাচ্ছি, এমন সময় ফেলুদা হঠাৎ বাঁ দিকের একটা আমগাছের দিকে চেয়ে থেমে গেল।
একটা ছেলে গাছের একটা নিচু ডালের উপর উঠে বসেছে, তার হাতে একটা কালসিটে পড়া সু-জুতো, যেটা নিশ্চয়ই চামড়ার ছিল, আর যেটা নিশ্চয়ই ছেলেটা এই জঞ্জালের মধ্যে থেকেই পেয়েছে।
ফেলুদা ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেল।
তোরা অনেক জিনিস পেয়েছিস এই জঞ্জাল থেকে, না রে?
ছেলেটা চুপ। সে একদৃষ্টি ফেলুদার দিকে চেয়ে আছে।
কী হল? বোবা নাকি?
ছেলেটা তাও চুপ। ফেলুদা হাপলেস বলে এগিয়ে চলল ক্র্যাশের জায়গা ছেড়ে গ্রামের দিকে! বলরামবাবুর কৌতুহল আবার চাগিয়ে উঠেছে। বললেন, আপনি কিছু খুঁজছেন নাকি স্যার?
একটা লাল পাথরের মূর্তি, ফেলুদা জবাব দিল,–শুধু মাথাটা।
শুধু মাথাটা…হুঁ… বলে বলরামবাবু দেখি এদিক ওদিক ঘাসের উপর খোঁজা আরম্ভ করে দিয়েছেন।
আমরা একটা অশ্বত্থ গাছের দিকে এগিয়ে গেলাম। গাছের তলায় একটা বাঁশের মাচা; তার উপর তিনজন আধাবুড়ো বসে তামাক খাচ্ছে। যে সবচেয়ে বুড়ে সে ফেলুদাকে জিজ্ঞেস করল, আপনারা কোত্থিকে আয়লেন?
কলকাতা। খুব জোর বেঁচে গেছে আপনাদের গ্রামটা!
হাঁ তা গ্যাচে বাবু। আল্লার কৃপা ঘর-বাড়ি ভাঙেনি মানুষজন মরেনি-বাছুর একটা বাঁধা ছিল করিমুদ্দির সেডা মোরেচে। আর আলম শ্যাখের–
আগুন লাগল কখন?
আগুন আর ধোঁয়া গোটা গেরামটা ধোঁয়ায় ধোঁয়া। আর তারপর অ্যালো বৃষ্টি, দমকল অ্যালো–
দমকল আসা অবধি আগুন জ্বলছিল?
আগুন নেভেছে বৃষ্টির জলে।
আপনি কাছাকাছি গিয়েছিলেন আগুন নেভার পর?
আমি বুড়ো মানুষ আমার অতো কী গরজ…
ছেলে ছাকরারা যায়নি? ওখান থেকে জিনিসপত্তর তুলে নেয়নি?
বুড়ো চুপ। অন্য দুজনও উসখুস। করছে। ইতিমধ্যে আট দশজন ছেলে জড়ো হয়ে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আমাদের কথাবার্তা শুনছে। ফেলুদা তাদের একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, তোর নাম কী রে?
ছেলেটি ঘাড় কত করে বলল, আলি।
এদিকে আয়।
ফেলুদা নরম সুরে কথা বলছিল বলেই বাধহয় ছেলেটা এগিয়ে এল।
ফেলুদা তার কাঁধে হাত দিয়ে গলাটা আরও নামিয়ে বলল, ওই ভাঙা প্লেনটা থেকে অনেক জিনিস ছড়িয়ে বাইরে পড়েছিল, জনিস তো?
ছেলেটি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
সেই সব জিনিসের মধ্যে একটা লাল পাথরের তৈরি মেয়েমানুষের মাথা ছিল। কুমোর যেমন মাথা গড়ে, সেইরকম মাথা।
এই ও জানে।
আলি আরেকজন ছেলের দিকে দেখিয়ে দিল। ফেলুদা একেও জিজ্ঞেস করল, তোর নাম কী রে?
পানু।
ফেলুদা বলল, আর কী নিয়েচিস তা আমার জানার দরকার নেই; মাথাটা ফেরত দিলে তোকে আমি বিকশিশী দেব।
পানুর মুখেও কথা নেই।
বাবু জিজ্ঞেস করচে জবাব দে–, তিন বুড়োর এক বুড়ো ধমক দিয়ে উঠল।
ওর কাছে নেই।
কথাটা বলল পানুরই বয়সী, মুখে বসন্তের দাগওয়ালা আরেকটি ছেলে।
কোথায় গেল? চাবুকের মতো প্রশ্ন করল ফেলুদা।
আরেকজন বাবু এসেচিল, তিনি চাইলেন, তাকে দিয়ে দিয়েচে।
সত্যি কথা? ফেলুদা পানুর কাঁধ ধরে প্রশ্ন করল। আমার বুক টিপটিপ করছে। পেতে পেতেও ফসকে যাবে যক্ষীর মাথা? পানু এবার মুখ খুলল।
একজন বাবু এলেন যে গাড়ি করে একটুক্ষণ আগে।
কীরকম গাড়ি?
নীল রঙের !-তিন চারটি ছেলে একসঙ্গে বলে উঠল।
কীরকম দেখতে বাবু? লম্বা? রোগ? মোটা? চশমা পরা?…
ছেলেদের বর্ণনা থেকে বোঝা গেল। মাঝারি হাইটের ভদ্রলোক, প্যান্ট শার্ট পরা, রোগাও না মোটাও না ফরাসাও না কলোও না, বয়স ত্রিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে; আমরা এসে পৌঁছানোর আধা ঘণ্টা আগে এসে একে তাকে জিজ্ঞেস করে অবশেষে পানুর কাছ থেকে সামান্য কিছু বকশিশ দিয়ে একটা লাল পাথরের তৈরি মানুষের মাথা উদ্ধার করে নিয়ে গেছেন। তার নীল রঙের গাড়ি।
আমরা যখন গ্রামের পথ দিয়ে গাড়িতে করে আসছিলাম তখন উলটো দিক থেকে একটা নীল রঙের অ্যাম্বাসাডরকে আমাদের গাড়ির পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখেছিলাম।
চল তোপসে—আসুন বলরামবাবু! খবরটা শুনে ফেলুদা যদি হতাশও হয়ে থাকে, সে ভাবটা যে সে এর মধ্যে কাটিয়ে উঠে আবার নতুন এনার্জি পেয়ে গেছে সেটা তার ট্যাক্সির উদ্দেশে দৌড় দেখেই বুঝলাম। আমরাও দুজনে ছুটলাম তাঁর পিছনে। কী আছে কপালে কে জানে!
০৩. যে পথে এসেছিলাম
যে পথে এসেছিলাম সেই পথেই আবার ফিরে চলেছি। দেড়টা বেজে গেছে, কিন্তু খাওয়ার কথা মনেই নেই। যশোহর রোডে পড়ে বলরামবাবু একবার বলেছিলেন, চা খাবেন নাকি স্যার? গলাটা একটু ভিজিয়ে নিলে…. ফেলুদা সে কথায় কান দেয়নি। বলরামবাবুও বোধহয় ব্যাপারটায় একটা অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পেয়ে আর চায়ের কথা বলেননি।
গাড়ি পঁচাত্তর কিলোমিটার স্পিডে ছুটে চলেছে, আর আমি ভাবছি কী অল্পের জন্যেই না মাথাটা ফসকে গেল। সকালে যদি লোডশেডিংটা না হত, আর রেডিয়োর খবরটা যদি ঠিক সময়ে শুনতে পেতাম, তা হলে এতক্ষণে হয়তো আমরা মূর্তি সঙ্গে নিয়ে আর্কিয়লজিক্যাল সার্ভের আপিসে ছুটে চলেছি। কিংবা হয়তো সোজা ভুবনেশ্বর। মন্দিরের গায়ে ভাঙা মূর্তি আবার জোড়া লেগে যেত, আর ফেলুদা তার জোরে হয়তো পদ্মশ্ৰী-টদ্মশ্ৰী হয়ে যেত।