ফোন করে জানা গেল মিস্টার সিলভারস্টাইন তাঁর ঘরে নেই, কখন ফিরবেন কোনও ঠিক নেই। ফেলুদা যেন একটু হতাশ হয়েই ফোনটা রেখে দিয়ে বলল, যে লোকটা মূর্তিটা বিক্রি করেছিল তার অন্তত চেহারার বর্ণনাটা পেলেও একটা রাস্তা পাওয়া যেত।
সেটা তো আমারই জিজ্ঞেস করা উচিত ছি, সিধুজ্যাঠা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন। —কিন্তু কেমন জানি সব গণ্ডগোল হয়ে গেল। ভদ্রলোক আবার আমার ছবিগুলো দেখছিলেন। দেখে বললেন, তার তান্ত্রিক আর্ট সম্পর্কে ইন্টারেস্ট, আমি সন্ধান পেলে যেন তাকে জানাই। এই বলে তার একখানা কার্ড বের করে আমার হাতে দিলে। …সত্যি, তুমি যে কীভাবে প্রোসিড করবে তা তো আমার মাথায় আসছে না।
দেখি, ভুবনেশ্বর থেকে কোনও খবর আসে কি না। রাজারাণীর গা থেকে মূর্তি ভেঙে নিয়ে গেলে তো হইচই পড়ে যাওয়া উচিত।
সিধুজ্যাঠা এক চুমুকে চা-টা শেষ করে উঠে পড়ে বললেন, বছরখানিক থেকে এ বাঁদরামির কথাটা কানে আসছিল, তবে অ্যাদ্দিন এদের নজরটা ছিল ছোটখাটা অখ্যাত মন্দিরের উপর। এখন মনে হচ্ছে এদের সাহসটা হঠাৎ বেড়ে গেছে। আমার ধারণা অত্যন্ত বেপরোয়া ও শক্তিশালী কিছু লোক রয়েছে এই কেলেঙ্কারির পেছনে। ফেলু। যদি এ ব্যাপারে কিছু করতে পার তো দেশ তোমাকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে মনে রাখবে এটা জোর দিয়ে বলতে পারি।
সিধুজ্যাঠা চলে যাবার পর ফেলুদা গ্র্যান্ড হোটেলে রাত এগারোটা পর্যন্ত বার বার ফোন করেও সেই আমেরিকানকে ধরতে পারল না। শেষবারের বার ফোনটা রেখে দিয়ে গভীর গলায় বলল, সিধুজ্যাঠা যা বলছে তা যদি সত্যি হয়—সত্যিই যদি ভুবনেশ্বরের যক্ষীর মাথা আমেরিকানদের হাতে চলে গিয়ে থাকে-তা হলে ব্যাপারটা অত্যন্ত অন্যায়; আর যে লোক এই পাচারের কাজটা করেছে। সে নিঃসন্দেহে একটা পয়লা নম্বরের ক্রিমিনাল। খারাপ লাগে ভাবতে যে আমার পক্ষে এগোনোর কোনও রাস্তা নেই; কোনওই রাস্তা নেই।
রাস্তা একটা বেরিয়ে গেল। পরদিনই। আর সেটা বেরোল এমন একটা দুর্ঘটনার মধ্যে দিয়ে যে ভাবলে মাথাটা ভোঁ ভোঁ করে।
০২. দুর্ঘটনার কথা
দুর্ঘটনার কথা বলার আগে আরেকটা জরুরি কথা বলা দরকার। সিধুজ্যাঠার আন্দাজ যে ঠিক সেটা পরদিনের আনন্দবাজারেই জানা গেল। আমিই প্রথম পড়লাম খবরটা–
মস্তকহীন যক্ষী
ভারতীয় স্থাপত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন ভুবনেশ্বরের রাজারানী মন্দিরের গাত্র থেকে একটি যক্ষীমূর্তির মস্তকাংশ অপহৃত হয়েছে। সেই সঙ্গে মন্দিরের প্রহরীটিকেও পাওয়া যাচ্ছে না। ওড়িশার প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ এ ব্যাপারে পুলিশ তদন্তের আয়োজন করেছে। বলে জানা গেল।
খবরটা পড়ে ফেলুদাকে বললাম, তার মানে পাহারাদারই মাথাটা চুরি করেছে?
ফেলুদা তার ফরহ্যানসের টিউবটা টিপে আধা ইঞ্চি পেস্ট বার করে ব্রাশের উপর চাপিয়ে বলল, এ চুরি কি আর পাহারাদরে করে? গরিব লোকের অতি সাহস হয় না। চুরি করেছে ভদ্রলোকে। সে মোটা ঘুষ দিয়েছে প্রহরীকে, প্রহরী তাই আপাতত গা ঢাকা দিয়েছে।
সিধুজ্যাঠা নিশ্চয়ই খবরটা পেয়েছে। আমার মন বলছিল যে তাঁর আন্দাজ ঠিক হয়েছে জেনে তিনি নিশ্চয়ই সদৰ্পে সেটা ঘোষণা করতে আসবেন। শেষ পর্যন্ত এলেন ঠিকই, কিন্তু সেটা চার ঘণ্টা পরে, সাড়ে দশটার সময়। আজ বিষুদৃদবার, নটা থেকে আমাদের বাড়ির বিজলি বন্ধ হয়ে গেছে, এদিকে আকাশে মেঘ করে গুমোট হয়ে রয়েছে, বৈঠকখানায় বসে ঘামছি, এমন সময় দরজায় প্রচণ্ড ধাক্কা। দরজা খুলতেই আবার সেই হুমদ্ভি দিয়ে ভেতরে ঢোকা, চায়ের হুকুম, আর পরীক্ষণেই ধাপ করে সোফায় বসা! ফেলুদা ভুবনেশ্বরের কথাটা উচ্চারণ করতেই তিনি এক দাবড়ানিতে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ও সব ছাড়ে। ওগুলো ফালতু কথা। রেডিয়া শুনেছ?
কইনা তো। আসলে আজ—
জানি। বিষুদবার। অথচ তাও একটা ট্রানজিস্টার কিনবে না। যাকগে.সাংঘাতিক খবর। কাঠমাণ্ডুর প্লেন ক্র্যাশ করেছে। কলকাতার কাছেই। এক ঘণ্টা ডিলে ছিল। সাড়ে সাতটায় মাটি ছেড়েছে, ফিফুটিন মিনিটসের মধ্যে ক্র্যাশ করেছে। ঝড়ে পড়েছিল। বোধহয় ফিরে আসবার চেষ্টা করছিল। কার সারারাত কীরকম ঝোড়ো বাতাস ছিল সে তো জানাই। আটান্নজন যাস্ত্রী, অল ডেড। মার্কিন ব্যাঙ্কার সাল সিলভারপ্রস্টাইন তার মধ্যে ছিলেন সে কথা রেডিয়োতে বলেছে।
খবরটা শুনে আমরা দুজনেই একেবারে থা। ফেলুদা বলল—কোথায় ক্র্যাশ করেছে? জায়গার নাম বলেছে?
সিদিকপুর বলে একটা গ্রামের পাশে। হাসনাবাদের দিকে। ফেলু, মনে মনে প্রার্থনা করছিলুম। সে মূর্তি যেন দেশ ছেড়ে না যায়। সে প্রার্থনা যে এমনভাবে মঞ্জুর হবে তা কি আর জানতাম?
ফেলুদা হাতের রিস্টওয়াচের দিকে দেখল। সে কি সিদিকপুর যাওয়ার মতলব করছে না। কি?
সিধুজ্যাঠারাও কেমন যেন তটস্থভাব। বললেন, আমি যা ভাবছি, তুমিও নিশ্চয় সেই কথাই ভাবছ। প্লেন মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা এক্সপ্লেশন হয়। যাত্রীর সঙ্গে তার ভেতরের জিনিসপত্রও চারদিকে ছিটকে পড়ে; যেমন সব ক্র্যাশেই হয়। সেই জিনিসপত্রের মধ্যে যদি…
ফেলুদা দু মিনিটের মধ্যে ঠিক করে ফেলল যে প্লেন যেখানে ক্র্যাশ করেছে সেখানে গিয়ে খোঁজ করবে। যক্ষীর মাথাটা পাওয়া যায় কি না। তিন ঘণ্টা হল ক্র্যাশটা হয়েছে, যেতে লাগবে ঘণ্টা দেড়েক। এর মধ্যে নিশ্চয়ই এয়ারলাইনের লোক, দমকল, পুলিশ ইত্যাদি সেখানে গিয়ে তাদের কাজকর্ম খোঁজাখুঁজি আরম্ভ করে দ্বিয়েছে। আমরা গিয়ে কী দেখতে পাব জানি না; তবু যাওয়া দরকার। সুযোগ যখন আশ্চর্যভাবে এসে গেছে তখন সেটার সদ্ব্যবহার না করার কোনও মানে হয় না।