অন্ধকার বেশ বেড়েছে, তাই কাগজের লেখাটা পড়তে আবার টর্চ জ্বালতে হল।
মাথাটা আপনার কাছে রাখুন। চাইলে দিয়ে দেবেন।
এটা ফেলুদা লালমোহনবাবুকে উদ্দেশ করে লিখেছে। লালমোহনবাবু ধরা গলায় জয় মা তারা বলে মাথাটাকে দুহাতে তুলে নিয়ে বগলদাবী করে নিজের জায়গায় নিয়ে এলেন।
আমি কাগজটা পকেটে পুরলাম।
বাইরে ফিকে চাঁদের আলো! থামের ফাঁক দিয়ে পশ্চিমের আকাশ দেখা যাচ্ছে, সে আকাশের রং এখন আশ্চর্যরকম বেগুনি।
ক্ৰমে সে রং বদলাল। চাঁদ বোধহয় বেশ ভাল ভাবে উঠেছে। গুহার মধ্যে জমাট বাঁধা অন্ধকারটা আর নেই।
আটটা -লালমোহনবাবু যেন অনেকক্ষণ চেপে রাখা নিশ্বাস ছেড়ে কথাটা বললেন। একটা অতি ক্ষীণ শব্দ। সিঁড়ি দিয়ে কে যেন উঠছে। ধীরে ধীরে অতি সাবধানে পা ফেলছে। এইবার শব্দ বদলাল। এবার সমতল মেঝেতে হাঁটছে। এবারে দুই থামের ফাঁক। দিয়ে দেখা গেল। লোকটা থেমেছে-এদিক ওদিক দেখছে। একটা খচ শব্দের সঙ্গে সঙ্গে একটা লাইন্টার জ্বলে উঠল। এক সেকেন্ডের আলো, কিন্তু তাতেই মুখ চেনা হয়ে গেছে।
জয়ন্ত মল্লিক।
আবার মাথা গণ্ডগোল হয়ে গেল। এবার যদি মরা মানুষ শুভঙ্কর বোসও এসে হাজির হন। তা হলেও আশ্চর্য হব না।
মল্লিক এগিয়ে এলেন, তবে আমাদের দিকে নয়। তিনি অন্য দিকের কোণে যাচ্ছেন। উত্তর-পূর্ব দিক। ওদিকে গাঢ় অন্ধকার। ভদ্রলোক সেই দিকে এগিয়ে গিয়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেলেন।
আমাদের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, আর আমার মন বলছে-ফেলুদা কোথায়?…ফেলুদা কোথায়?…ফেলুদা কোথায়?… লালমোহনবাবু বাক্স রহস্যের ঘটনার পর বলেছিলেন ডিটেকটিভ উপন্যাস লেখা ছেড়ে দেবেন, কারণ বাস্তব জীবনে বানানো গল্পের চেয়ে অনেক বেশি অবিশ্বাস্য আর রোমাঞ্চকর সব ঘটনা ঘটে। এই যক্ষীর মাথার ঘটনার পরে উনি কী বলবেন কে জানে!
চাঁদের আলো বেড়েছে। দূরে একটা কুকুর ডাকল। তারপর আরেকটা। তারপর থমথমে চুপ।
তারপর আরেকটা শব্দ।
এবার মেঝে দিয়ে হাঁটছে। এবার দুই থামের ফাঁক দিয়ে দেখা গেল তাকে। এখনও চেনা যাচ্ছে না। এবার সে লোক এগিয়ে এল। এবার আমাদেরই দিকে। প্রায় নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে। এক পা এক পা করে।
হঠাৎ চোখের সামনে চোখধাঁধানো আলো। লোকটা টর্চ জ্বেলেছে। শুধু টর্চই দেখছি, লোকটাকে দেখছি না। টৰ্চটা আমাদের উপর ফেলা। সেটা এগিয়ে এল। থামল। তারপর একটা চেনা গলার স্বর-চাপা, কিন্তু কথাগুলো ভীষণ স্পষ্ট–
বামন হয়ে চাঁদে হাত? অ্যাঁ, বাছাধন? আবার হুমকি দিয়ে চিঠি লিখতে শেখা হয়েছে?–দশাবতার গুহায় আটটার সময় আসিবেন, সঙ্গে পাঁচশত টাকা আনিবেন।.তবে আপনার যাহা খেয়া গিয়াছে তাহ পাইবেন, নতুবা.-এ সব কেথেকে শেখা হল, ইতিহাসের অধ্যাপক? কথাগুলো কানে ঢুকছে না, এখনও কালা সেজে বসে আছ? এই ব্যাপারে তুমি জড়ালে কী করে? খাতায় আবার নোট করা রয়েছে দেখলাম।–ফকার ফ্রেন্ডশিপ ক্র্যাশ, ভুবনেশ্বরের যক্ষী, কৈলাসের মন্দির, প্লেনের টাইম…। আবার সঙ্গে একটা নাবালককে রেখেছি কেন? ও কি তোমার বডিগার্ড? আমার ডান হাতে কী আছে দেখতে পাচ্ছ কি?
মিস্টার রক্ষিত। এক হাতে পিস্তল, এক হাতে টর্চ।
লালমোহনবাবু দুবার আমি আমি বলে থেমে গেলেন। রক্ষিতের চাপা হুমকিতে গুহার ভেতরটা কেঁপে উঠিল–
আমি আমি ছাড়ো। আসল মাল কোথায়?
এই যো। আপনার জন্যই…
লালমোহনবাবু যক্ষীর মাথাটা রক্ষিতের দিকে এগিয়ে দিলেন। ভদ্রলোক পিস্তলের হাত ঠিক রেখে, টর্চের হাত দিয়ে মাথাটাকে বগলদাবা করে নিয়ে ঝাঁঝালো সুরে বললেন, এ সব ব্যবসা সকলকে মানায় না, বুঝেছি? যেমন ছোট মুখে বড় কথা মানায় না, তেমন ছোট বুকে বড় সাধ মানায় না।
মিস্টার রক্ষিতের কথা হঠাৎ থেমে গেল। কারণ, একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটছে। গুহার ভিতর। –বাইরের দিক থেকে একটা ধোঁয়ার কুণ্ডলী গুহার ভিতর ঢুকে চারদিক ছেয়ে ফেলছে, আর তার ফলে কালো কালো থামগুলো যেন তালগোল পাকিয়ে অদৃশ্য হয়ে আসছে।
সেই ধোঁয়ার ভিতর থেকে হঠাৎ একটা গমগমে গলার স্বর শোনা গেল। ফেলুদার গলা; পাথরের মতো ঠাণ্ডা আর কঠিন সে গলা–
মিস্টার রক্ষিত, আপনার দিকে, একটি নয়, এক জোড়া পিস্তল সোজা ত্যাগ করা রয়েছে। আপনি নিজের পিস্তলটা নামিয়ে ফেলুন।
কী ব্যাপার? এ সবের অর্থ কী? মিস্টার রক্ষিত কাঁপা গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন।
অর্থ খুবই সহজ, ফেলুদা বলল-আপনার অপরাধের শাস্তি দিতে এসেছি আমরা। অপরাধ একটা নয়—অনেকগুলো। প্রথম হল—ভারতের অমূল্য শিল্পসম্পদকে নির্মমভাবে ধ্বংস করা; দ্বিতীয়, এই শিল্পসম্পদকে অর্থের লোভে বিদেশিদের কাছে বিক্রি করা; আর তৃতীয়-শুভঙ্কর বোসকে নির্মমভাবে হত্যা করা।
মিথ্যে! মিথ্যে।-রক্ষিত চিৎকার করে উঠলেন। -শুভঙ্কর বোস খাদের উপর থেকে পা হড়কে…
মিথ্যেটা আমি বলছি না, বলছেন। আপনি। যে শাবল দিয়ে আপনি তাকে মেরেছিলেন। সেই শাবল রক্তমাখা অবস্থায় খাদ থেকে পঞ্চাশ হাত দূরে একটা মনসার ঝোপের ভিতর পাওয়া গেছে। শুভঙ্কর বোস জ্যান্ত অবস্থায় খাদে পড়লে তিনি নিশ্চয় চিৎকার করতেন; অথচ কৈলাসের পাহারাদার কোনও চিৎকার শোনেনি। আর তা ছাড়া আপনার একটা নীল শার্ট আপনি বাংলোর পূর্বদিকে গাছপালার মধ্যে লুকিয়ে রেখে এসেছিলেন। সেটা আমিই গিয়ে উদ্ধার করি। এই শার্টের একটা অংশ একটু ছেড়া। মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে শুভঙ্কর বোসের-