মিস্টার জয়ন্ত মল্লিক।
কোথায় পেলে ওটা?—কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম। ফেলুদা বলল, উপূড় হয়ে পড়েছিল শুভঙ্কর বাস। হাত দুটো ছড়ানো। বাঁ হাতটা মুঠো অবস্থায়। দু আঙুলের মাঝখান দিয়ে টুকরোটা বেরিয়ে ছিল। দুজনে ধস্তাধস্তি হয় খাদের ধারে। শুভঙ্কর শার্ট খামচিয়ে ধরে। তারপর পড়ে যায়। টুকরোটা হাতে ছিঁড়ে আসে।
ওপর থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল কি? লালমোহনবাবু প্রশ্ন করলেন। ত্তার মানে তো ম্-মাডার।
ফেলুদা লালমোহনবাবুর কথায় কোনও মন্তব্য না করে গভীরভাবে বলল, একটা কথা বলতেই হবে—কৈলাস এখনও অক্ষত রয়েছে, আর সেটার জন্য দায়ী শুভঙ্কর বোস। তিনি মরলেন বলেই মূর্তি চারকে কাজ না সেরেই পালাতে হল। আর সেই সঙ্গে লালমোহনবাবুর ভবিষ্যদ্বাণীও ফলে গেল। কৈলাসে সত্যিই লাশ পাওয়া গেল!
০৯. ফিল্ম কোম্পানির লোকেরা
খাদের মাথা থেকে যখন নীচে নামলাম ততক্ষণে ফিল্ম কোম্পানির লোকেরা সরে পড়েছে। তার বদলে এখন স্থানীয় লোকের ভিড়। আর আমেরিকান গাড়ির বদলে রয়েছে একটা জিপ। একজন বছর পয়ত্ৰিশের স্মার্ট ভদ্রলোক ফেলুদাকে দেখে এগিয়ে এলেন। ইনিই নাকি মিস্টার কুলকার্নি-টুরিস্ট গেস্ট হাউসের ম্যানেজার। ফেলুদার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা হল। ভদ্রলোক বললেন, কাল রাত্রে যে মিস্টার বোস ফেরেননি। সেটা আজ ভোরে জানা গেছে। একটি বেয়ারাকে পাঠিয়েছিলাম ওর খোঁজ করতে, সে না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে আসে।
এখন কী ব্যবস্থা হচ্ছে? ফেলুদা প্রশ্ন করল। কুলকার্নি বললেন, আওরঙ্গাবাদে খবর পাঠানো হয়েছে। সি ডি ভ্যান আসছে, ডেডবডি মর্গে নিয়ে যাবে। মিস্টার বোসের ভাই আছেন দিল্লিতে। লাশ সনাক্ত করার ব্যাপারে তাকে খবর পাঠানো হচ্ছে। …ভেরি স্যাড! ভদ্রলোক সত্যিই পণ্ডিত ছিলেন। আগেও একবার এসেছিলেন—সিকসটি এইটে। গেস্ট হাউসেই ছিলেন। এলোরার ওপর বই লিখছিলেন।
আপনাদের এখানে থানা নেই?
একটা পুলিশ আউটপোস্ট আছে। ছোট জায়গা তো! একজন অ্যাসিসন্টান্ট সাব-ইনসাপেক্টর চার্জে আছেন। মিস্টার ঘোটে। আপাতত ডেডবডি ইনসাপেক্ট করছেন।
আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে পারেন?
সার্টেনলি!…ভাল কথা—
কুলকার্নি কী যেন একটা গোপনীয় কথা বলতে চাইছেন, কিন্তু আমরা দুজন বাইরের লোক রয়েছি বলে ইতস্তত করছেন। ফেলুদা বলল, আপনি এদের সামনে বলতে পারেন। কুলকার্নি আশ্বস্ত হয়ে বললেন, আজ সকালে বম্বেতে একটা ট্রাঙ্ক কল হয়েছে।
মল্লিক?
হ্যাঁ।
কী বলল নোট করেছেন?
কুলকার্নি পকেট থেকে একটা কাগজের স্লিপ বার করে সেটা থেকে পড়ে বললেন, মে বালু আচে। আজ রওয়ানা হচি।
মেয়ে ভাল আছে, আজ রওনা হচ্ছি। আবার সেই মেয়ের ব্যাপার।
যাবার কথা বলেছে কিছু? ফেলুদা চাপা উত্তেজনার সঙ্গে প্রশ্ন করল।
কুলকার্নি বললেন, উনি তো আজই সকলে যেতে চাইছিলেন, কিন্তু আমি আপনার কথা ভেবেই একটা ফন্দি বার করে যাওয়াটা পিছিয়ে দিয়েছি। ওর ট্যাক্সির ড্রাইভারকে টিপে দিয়েছি। ডিফারেনসিয়াল গণ্ডগোল—গাড়ি সারাতে টাইম লাগবে।
ব্রাভো! আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন।
ফেলুদার তারিফে কুলকার্নির চোখ খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠল। ফেলুদা একটা চারমিনার ধরিয়ে বলল, ভাল কথা-আপনার এই ঘোটে লোকটি কেমন?
বেশ লোক। তবে মনমরা হয়ে থাকে। এ জায়গা তার ভাল লাগে না। কবে। প্রোমোশন হবে, আওরঙ্গাবাদে পোস্টেড হবে, তাই দিন গুনছে। …আসুন না, আলাপ করিয়ে দিই।
মিস্টার ঘোটে কেভ থেকে বেরিয়ে এসেছেন, কাছাকাছির মধ্যেই ছিলেন, কুলকার্নি তাঁকে ডেকে এনে ফেলুদাকে বিখ্যাত প্রাইভেট ডিটেকটিভ বলে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ভদ্রলোক লম্বায় সাড়ে পাঁচ ফুট, চওড়াতেও প্রায় ততখানিই বলে মনে হয়, তার উপরে আবার চার্লি চ্যাপলিনের মতো গোঁফ। কিন্তু মোটা হলে কী হবে, হাঁটাচলা বেশ চটপটে।
ঘোটের সঙ্গে কথা বলার আগে ফেলুদা আমাদের দিকে ফিরে বলল, তোরা বরং বাংলোয় ফিরে যা-আমি ভদ্রলোকের সঙ্গে একটু কথা বলে আসছি।
কী আর করি। গেলাম ফিরে বাংলোয়। ভোরে শুধু চা খেয়ে বেরিয়েছিলাম, তাই বেশ খিদে পাচ্ছিল। বারান্দায় গিয়ে চৌকিদারকে হাঁক দিয়ে দুজনের জন্য ডিমরুটি করতে বলে দিলাম।
ঘরে ফিরে এসে দেখি লালমোহনবাবু কেমন যেন বোকা বোকা ভাব করে খাটে বসে আছেন। আমার্কে দেখে বললেন, আমরা কি বেরোবার সময় ঘরের দরজা বন্ধ করে। গিয়েছিলাম?
আমি বললাম, না তো। নেবার মতো কীই বা আছে বলুন! তা ছাড়া এরা তো সকালবেলা ঘর ঝাড়পোছ করে, তাই…কেন, কিছু হারিয়েছে নাকি?
না, কিন্তু জিনিসপত্তর সব ওলট-পালট হয়ে আছে। আমার খাটে বসে আমার বাক্স ঘেঁটেছে। এই কিছুক্ষণ আগে। খাট এখনও গরম হয়ে আছে। তোমার বাক্সটা দেখো তো।
সুটকেসটা খোলামাত্র বুঝতে পারলাম সেটা কেউ ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। যেটা যেখানে ছিল সেটা সেখানে নেই। শুধু বাক্স না, বালিশ-টালিশও এদিক ওদিক হয়ে আছে। এমন কী থাটের তলাতেও যে খুঁজেছে সেটা আমার চটি জোড়া যেভাবে রাখা হয়েছে তার থেকে বুঝতে পারছি।
লালমোহনবাবু বললেন, কীসের জন্য সবচেয়ে ভয় ছিল জান? আমার নেটবুকটা। সেটা দেখছি নেয়নি।
অন্য কিছু নিয়েছে নাকি?
কই, কিছুই তো নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। তোমার?
আমারও তাই। কিছুই নেয়নি। যে এসেছিল সে বিশেষ কোনও একটা জিনিস খুঁজতে এসেছিল। সেটা পায়নি।