রক্ষিত কী জানি একটা উত্তর দিতে গিয়ে আর দিতে পারলেন না। কৈলাসের দিক থেকে একটা বিকট চিৎকার এসে আমাদের সকলেরই পিলে চমকে দিয়েছে। লালমোহনবাবু পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে লাফিয়ে উঠে বললেন, ফাইট শুরু হয়ে গেছে মশাই! ভিলেন চ্যাঁচাচ্ছে!
চিৎকারের পর আরও অন্য গলায় চোচামেচি শুরু হয়েছে। ফাইট হলে এত লোক চেচাবে কেন? আমরা ফেলুদার পিছন পিছন ব্যস্তভাবে কৈলাসের দিকে এগিয়ে গেলাম। এত ছুটোছুটি গোলমাল কীসের জন্য?
যখন গেটের কাছাকাছি এসে গেছি তখন দেখলাম চার-পাঁচজন লোক চ্যাংদোলা করে একটি বেগুনি হাওয়াইয়ান শার্ট পরা লোককে হলদে গাড়িটার দিকে নিয়ে গেল। তারপর বেরিয়ে এল হিরো হিরোইন আর ভিলেন। এদের তিনজনেরই মুখ চেনা। রূপা অৰ্জ্জুনের কাঁধে ভর করে এগিয়ে আসছে, বলবন্ত তাদের পাশেই মাথা হেঁট করে রূপার কাঁধে একটা হাত দিয়ে যেন তাকে সাস্তুনা দিচ্ছে। এবারে সেই বাঙালি ছেলেটিকে দেখে আমরা চারজনেই তার দিকে এগিয়ে গেলাম।
কী হয়েছে মশাই? লালমোহনবাবু প্রশ্ন করলেন।
লাশ পড়ে আছে। মন্দিরের পেছন দিকে… হরিবল ব্যাপার…হাড়গোড় সব….
চ্যাংদোলা করে নিয়ে গেল কাকে?
আপ্পারাও। উনিই প্রথম দেখলেন, আর দেখেই সেনসলেস।
ফেলুদা আর মিস্টার রক্ষিত আগেই মন্দিরে ঢুকে গিয়েছিল। এবার আমরা দুজনও গেলাম; ফিল্মের লোকজন সব বেরিয়ে আসছে, বুঝলাম শুটিং আর হবে না।
মন্দিরের বাঁ দিকের প্যাসেজ দিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি, ডানদিকে কৈলাসের নীচের দিকটায় সারি সারি হাতি আর সিংহের মূর্তি; মনে হয় তারাই যেন মন্দিরটাকে কাঁধে করে রয়েছে। সামনে মাড় ঘুরে ডান দিকে গিয়েই বাধহয় মৃতদেহ, কারণ সেখানে কিছু লোক দাঁড়িয়ে নীচের দিকে চেয়ে রয়েছে। আমরা পৌঁছানোর আগেই মিস্টার রক্ষিত ভিড় থেকে বেরিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, ওদিকে যাবেন না। বিশ্ৰী ব্যাপার। আমারও যে খুব একটা যাবার ইচ্ছে ছিল তা নয়, কারণ এ ধরনের রক্তাক্ত দৃশ্য দেখতে ভাল লাগে না; তবু কে মারা গেছে জানার ভীষণ কৌতুহল হচ্ছিল। সে কৌতুহলটা মিটিয়ে দিল ফেলুদা। মিস্টার রক্ষিত চলে আসবার এক মিনিটের মধ্যেই ফেলুদাও ফিরে এসে বলল, শুভঙ্কর বোস। মনে হয় পাহাড়ের উপর থেকে সোজা পড়েছেন পাথরের মাটিতে।
লালমোহনবাবু শুনলাম বিড়বিড় করে বলছেন, আশ্চর্য। ঠিক এইভাবেই মরবার কথা ঘনশ্যাম কর্কটের।
ফেলুদা আবার বাইরের দিকে চলেছে, আমরা দুজন তাঁর পিছনে। মিস্টার রক্ষিত এগিয়ে গিয়েছিলেন, আমাদের আসতে দেখে থেমে বললেন, কাল রাত্রে যখন এদিকটায় বেড়াতে আসি, তখনই দেখলাম ভদ্রলোক পাহাড়ের উপর উঠছেন। আমি বারণ করেছিলাম। ভদ্রলোক আমার কথায় কানই দিলেন না। তখন কি জানি যে লোকটা আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে?
মিস্টার রক্ষিত চলে গেলেন। একটা নতুন কথা বলে গেলেন বটে। ভদ্রলোক। আত্মহত্যার কথাটা আমার মনেই হয়নি। ফেলুদা মিস্টার রক্ষিতের কথায় যেন আমল না। দিয়েই আবার কৈলাসের বাঁ দিক দিয়ে পাহাড়ে উঠতে আরম্ভ করল।
আধঘণ্টা আগেই দেখেছিলাম খাদের পাশে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে, এখন দেখছি একটি লোকও নেই। মনে মনে বললাম শুভঙ্কর বাস মরে গিয়ে আমাদের কাজের সুবিধে করে দিয়েছেন।
ফেলুদা দেখলাম বেশ বেপরোয়াভাবে এগিয়ে গিয়ে খাদের ধারে দাঁড়িয়ে ঘাড় নিচু করে মন্দিরের পিছনে যেখানে মৃতদেহ পড়ে আছে সেখানটা দেখছে। যেখান থেকে পড়েছেন শুভঙ্কর বাস, সেই জায়গাটা আন্দাজ করে ও খাদের আশপাশটা খুব ভাল করে দেখতে লাগল।
মাটিতে একটা গর্ত। লোক চলাচলে মাটি ঢুকে সেটা খানিকটা বুজে এসেছে, কিন্তু তাও ব্যাগ থেকে ভাঁজ করা স্কেলটা খুলে তার মধ্যে ঢোকাতে সেটা প্রায় দেড় হাত ভেতরে চলে গেল। গর্তটা খাদ থেকে হাত তিনেক দূরে। এবার ফেলুদা গর্তটার ঠিক সামনে খাদের ধারটা পরীক্ষা করতে লাগল। আমি আর লালমোহনবাবুও দেখছি আর বেশ বুঝতে পারছি কোন জিনিসটা ফেলুদার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
খাদের ধারের মাটির উপর একটা গভীর খাঁজ পড়েছে।
কিছু বুঝতে পারছিস, তোপসে? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল। আমি চুপ করে আছি দেখে সে নিজেই উত্তর দিল—
এটা দড়ির দাগ। একটা শাবল গোছের জিনিস গভীরভাবে পুঁতে সেটায় একটা দড়ি বেঁধে খাদের ভিতর ঝুলিয়ে সেটা ধরে কেউ নেমেছিল বা নামতে চেষ্টা করেছিল। কাল রাত্রে খস খসি শব্দটা মনে পড়ছে? সেটা ছিল দড়িটাকে টেনে তোলার শব্দ। সামনে দিয়ে ঢোকার উপায় নেই, তাই পিছন দিয়ে ঢোকার এই ব্যবস্থা।
লালমোহনবাবু বললেন, কিন্তু দড়ি হলে…একশো ফুট.মানুষ ধরে নামবে…সে তো মোক্ষম দড়ি হতে হবে মশাই।
নাইলনের দড়ি। হালকা, অথচ প্ৰচণ্ড শক্ত, বলল ফেলুদা।
আমি বললাম, তার মানে তো শুভঙ্কর বোস ছাড়া আরেকজন লোক ছিল?
ন্যাচারেলি। সেই লোকই দড়ি টেনে তুলেছে, সেই শাবল-দড়ি সরিয়ে ফেলেছে। সে শুভঙ্কর বোসের শত্রু বা মিত্র সেটা এখনও ষোলো আনা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না, তবে একটা কারণে শত্রু বলেই মনে হয়।
আমরা ফেলুদার দিকে চাইলাম। ফেলুদা তার শার্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা ছোট্ট জিনিস বার করে হাতের তেলোয় ধরে আমাদের দেখাল।
একটা ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো। নীল রঙের কাপড়। কাল কাকে দেখেছি নীল শার্ট গায়ে?