ঠিক। ফেলুদা চোখ বুজে মাথা নেড়ে সায় দিল।
এই অ্যাটের মধ্যেও যেটা সেরা, সেটা হল ভারতবর্ষের মন্দির, আর তার গায়ের কারুকার্য। ঠিক কি না?
ঠিক।
সিধুজ্যাঠা জানেন না। এমন বিষয় নেই। তবে তার মধ্যেও আর্টের বিষয়ে তাঁর জ্ঞান বোধহয় সবচেয়ে বেশি, কারণ, তাঁর তিন আলমারি বইয়ের মধ্যে দেড় আলমারিই হল আর্টের বই। কিন্তু খুনের কথা কী বলছিলেন সেটা এখনও বোঝা গেল না।
একটা মাদ্রাজি চুরুট ধরাবার জন্য খানিকটা সময় নিয়ে এক ঘর ধোঁয়া ছেড়ে দুবার কেশে একটু দম নিয়ে সিধুজ্যাঠা বললেন, এককালে কালাপাহাড় ধর্ম চেঞ্জ করে হিন্দু মন্দিরের কী সৰ্ব্বনাশ করে গেছে সে তো জান। কিন্তু আজ এই উনিশশো তিয়াত্তরে আবার যে কালাপাহাড়ের আবির্ভাব হয়েছে সেটা জান কি?
আপনি কি মন্দিরের গা থেকে মূর্তি খুলে নিয়ে ব্যবসা করার কথা বলছেন? ফেলুদা প্রশ্ন করল।
এগজাক্টলি! সিধুজ্যাঠা উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠলেন। এটা যে কতবড় একটা ক্ৰাইম সেটা ভাবতে পার? দোহাইটা এখানে ধর্মেরও নয়, স্রেফ ব্যবসার। ধনী আমেরিকান টুরিস্টরা এইসব মূর্তি হাজার হাজার টাকা দিয়ে কিনে বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে, অথচ ব্যাপারটা এমন গোপনে হচ্ছে যে ধরার কোনও উপায় নেই। তবে এইসব শিল্প হত্যাকারীদের সংখ্যা যে ক্রমেই বাড়ছে তাতে সন্দেহ নেই। আজ দেখলুম ভুবনেশ্বরের রাজারাণী মন্দিরের একটা যক্ষীর মাথা গ্র্যান্ড হোটেলে এক আমেরিকান টুরিস্টের কাছে।
বলেন কী ফেলুদা রীতিমতো অবাক। রাজারাণী যে ভুবনেশ্বরের একটা বিখ্যাত মন্দির সেটা আমিও জানতাম। ছেলেবেল পুৱী-ভুবনেশ্বরে বেড়াতে গিয়েছিলাম, বাবা দেখিয়ে দিয়েছিলেন। লাল পাথরের মন্দির, তার গায়ে অদ্ভুত সব মূর্তি আর নকশা।
সিধুজ্যাঠা বলে চললেন, আমার কাছে কিছু পুরনো রাজপুত পেন্টিং ছিল, থার্টি-ফোরে কিনেছিলুম কাশীতে, সেইগুলো নিয়ে গিয়েছিলুম নগরমলকে দেখাতে। নগরীমলের দোকান আছে জান তো গ্র্যান্ড হাটেলের ভেতরে?–আমার অনেক দিনের চেনা। ছবিগুলো খুলে রেখেছি কাউন্টারের উপর, এমন সময় এই মার্কিন বাবুট এলেন। মনে হল নগরীমলের কাছ থেকে আগে কিছু জিনিসটিনিস কিনেছে। হাতে একটা কাগজের মোড়ক। বেশ ভারী জিনিস বলে মনে হল। মোড়কটি যখন খুললে না-বলব কী ফেলু-আমার হৃৎপিণ্ডটা একটা লাফ মেরে গলার কাছে চলে এল। একটা মূর্তির মাথা। লাল পাথরের তৈরি। আমার চেনা মুখ, শুধু তফাত এই যে সে মুখকে ধড়ের সঙ্গে লাগা অবস্থায় দেখেছি, আর এখন দেখছি সেটাকে ছেনি দিয়ে ধড় থেকে আলাদা করে নেওয়া হয়েছে। আমার তো মুখ দিয়ে কথাই বেরুচ্ছে না। নগরমল দেখে বললে জিনিসটা খাঁটি, ছাঁচ বা নকল নয়। সে মার্কিন ছাকরা বললে দু হাজার ডলার দিয়ে কিনেছে কোন প্রাইভেট ডিলারের কাছ থেকে। আমি মনে মনে বললুম—যা ভাবছি তাই যদি হয় তা হলে আরও দুটো শূন্য বাড়িয়ে দিলেও ন্যায্য দাম দেওয়া হত না। যাই হাক, সে ব্যাটা তো হোটেলে চলে গেল, আমি নিজেও ষোলো আনা শিওর হতে পারছিলুম না, তাই সোজা বাড়ি এসে জিমারের বই খুলে দেখি কী-যা ভেবেছিলুম তাই! ও মুণ্ডু খসে রাজারাণীর গা থেকে ভেঙে আনা হয়েছে। অথচ এ সব মন্দিরে সরকারি পাহারা থাকে। ঘুষ খেয়েছে নিশ্চয়ই। আজকাল তো ওইটেই চাবিকাঠি কিনা। আমি অবিশ্যি এর মধ্যেই ভুবনেশ্বরের আর্কিয়লজিক্যাল ডিপার্টমেন্টে এক্সপ্রেস চিঠি লিখে দিয়েছি। কিন্তু তাতেই বা কী হবে। ওই পার্টিকুলার মাথাটাকে তো আর বাঁচানো গেল না; আর মন্দির যা জখম হবার তাও হয়ে গেল।
আমারও মনে হচ্ছিল যে এইভাবে আমাদের মন্দিরের মূর্তি ভেঙে বিদেশের লোককে বিক্রি করাটা সত্যিই একটা ক্রাইম।
শ্ৰীনাথ চা এনে দিয়েছে, সিধুজ্যাঠা কাপ তুলে একটা চুমুক দিয়ে গভীর গলায় বলল, ভাবছি কীভাবে এর প্রতিকার হয়। আমি বুড়ো হয়ে গেছি, আমি আর কী করতে পারি বলো। তাই বুঝলে ফেলু, তোমার কথাটাই বার বার মনে হচ্ছিল। তুমি প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর, অপরাধী খুঁজে বেড়াও তুমি, এর চেয়ে বড় আর কী অপরাধ থাকতে পারে? এই নিয়ে কাগজে লেখালেখি করলে হয়তো পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়, কিন্তু তাতেই বা কী ভরসা? এ তো আর সোনা রুপো বা হিরেজহরত নয়, যার দামটা বাজারদার থেকে হিসেব করে নেওয়া যায়। আর্টের ভ্যালুটা অন্য রকম; সেটা সবাই বোঝে না। আমি এমনও শিক্ষিত লোক জানি যারা জোড়বাংলা মন্দির দেখে বলে ওর মধ্যে আর কী আছে, আর কাংড়া ছবি দেখে বলে এর চেয়ে হেমেন মজুমদার ভাল।
ফেলুদা এতক্ষণ চুপ করে ভাবছিল। এবার বলল, সেই আমেরিকান ভদ্রলোকের নামটা জেনেছিলেন কি?
জেনেছি বইকী। এই যে তার কার্ড।
সিধুজ্যাঠা তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বার করে ফেলুদাকে দিল। উঠে গিয়ে দেখলাম তাতে নাম ছাপা রয়েছে–সল সিলভারস্টাইন–আর তার নীচে
ইহুদি, সিধুজ্যাঠা বললেন।—স্টাইন দেখলেই বুঝবে ইহুদি। লোকটা ডাকসাইটে ধনী। তাতে সন্দেহ নেই। হাতে একটা ঘড়ি পরেছিল। তেমন ঘড়ি বাপের জন্মে দেখিনি। তারই দাম বোধহয় হাজারখানেক ডলার।
ভদ্রলোক ক’দিন থাকবেন কিছু বলেছিলেন?
কাল সকালেই কাঠমাণ্ডু চলে যাচ্ছে। অবিশ্যি এখন হয়তো তাকে ফোন করলে পেতে পার।
ফেলুদা উঠে গিয়ে টেলিফোনের ডায়াল ঘোরাতে লাগল। কলকাতার বেশির ভাগ জরুরি টেলিফোনের নম্বর ওর মুখস্ত। তার মধ্যে অবিশ্যি হাটেলও বাদ পড়ে না।